অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর এখনো উদ্ধার হয়নি দেড় হাজার অস্ত্র

বর্তমান সরকারের এই এক বছরে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে পুলিশ বাহিনীকে। গত বছরের ৫ আগস্ট থানা ও স্টেশনগুলো ফেলে পালিয়ে গিয়েছিল পুলিশ সদস্যরা। লুট হয়েছিল তাদের আগ্নেয়াস্ত্র। লুট হওয়া অস্ত্রের একটা অংশ উদ্ধার হলেও এখনো প্রায় দেড় হাজার আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হয়নি। যেগুলো অপরাধীদের কাছে চলে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আগামী নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই।
এমন পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গতকাল রোববার সাংবাদিকদের বলেছেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর যেসব অস্ত্র হারিয়ে গেছে বা লুট হয়েছে তা উদ্ধারের ব্যাপারে একটা পুরস্কারও ঘোষণা করা হচ্ছে। যারা সন্ধান দিতে পারবে তাদের পুরস্কৃত করা হবে। দুই-এক দিনের মধ্যে এটি জানানো হবে। নির্বাচনের আগে এই অস্ত্র উদ্ধারের আশার কথা বলেন তিনি।
যদিও স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ অস্ত্র উদ্ধার বাকি রয়েছে। কিন্তু পুলিশের হিসাবে ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সরকার পতনের পর বিভিন্ন থানা ও পুলিশি স্থাপনা থেকে ৫ হাজার ৮১৮টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র এবং ৬ লাখ ৭ হাজার ২৬২টি গোলাবারুদ লুট হওয়ার তথ্য এসেছিল।
গত মাসে ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদরের মিলিটারি অপারেশনস ডিরেক্টরেটের (স্টাফ কর্নেল) কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী লুট হওয়া ৮০ শতাংশ অস্ত্র উদ্ধার করেছে। বাকি ২০ শতাংশ অস্ত্র আসন্ন নির্বাচনের আগে জব্দ করা হবে। যাতে আগামী নির্বাচনে এসব অস্ত্র দিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারে অপরাধী চক্রগুলো। গত এক বছরের লুট হওয়া এসব অস্ত্র দিয়ে কেউ খুনোখুনিতে লিপ্ত হয়েছে, কেউ আবার বিক্রি করে দিয়েছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষীবাহিনী জোরেশোরে নেমেছিল। পরে তার গতি কমে যায়। যদিও যৌথ বাহিনী বিভিন্ন স্থানে আবার অভিযান শুরু করেছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশে অপরাধ বৃদ্ধির বড় কারণ অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্রেও বাড়ছে অপরাধ। বিশেষ করে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবারে অবৈধ অস্ত্র বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসন্ন নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে বড় রকমের হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই নির্বাচনকে সামনে রেখে লুটের অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের বিকল্প নেই। পুলিশ বলছে, লুটের অস্ত্র উদ্ধারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনই কমবেশি অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে গত বছরের অক্টোবর-নভেম্বরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে গোলাগুলি করে একাধিক হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উদ্ধার করা হয় ময়মনসিংহের কোতোয়ালির মো. মোতালেবের মেয়ে শাহিদা ইসলামের গুলিবিদ্ধ লাশ। তিনি পুরান ঢাকার ওয়ারীতে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকতেন। এ ঘটনায় তার প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে গ্রেফতার করা হয়। পরে জানা যায়, শাহিদাকে যে অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেটি ছিল পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র।
পুলিশের তথ্য বলছে, উদ্ধার না হওয়া বিপুলসংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র অপরাধীদের হাতে চলে গেছে বহু আগেই। সর্বশেষ গত ২৮ মে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানা এলাকা থেকে মো. পারভেজ ও রিয়াজুর রহমান নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ সময় দুই জনের কাছ থেকে ধারালো দেশীয় অস্ত্রসহ একটি রিভলভার ও গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ বলছে, এসব রিভলভার ও গুলি গত বছরের ৫ আগস্ট পাহাড়তলী থানা থেকে লুট করে দুর্বৃত্তরা। ঐ দুই ব্যক্তি লুট করা অস্ত্র দিয়ে পাহাড়তলী টোল সড়কে বিমানবন্দর ও পতেঙ্গাগামী যাত্রীদের ছিনতাই করত।
সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষা করতে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্টের পর দেশের ৬৬৪টির মধ্যে ৪৬০ থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট হয়। ১১৪টি ফাঁড়িতেও লুটপাট চালায় দুর্বৃত্তরা। থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে পিস্তল, রিভলভার, শটগানসহ ১১ ধরনের প্রায় ৬ হাজার অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ৪ হাজার ৩৮৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৩৬৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া লুট হওয়া ৬ লাখ ৫১ হাজার ৮৩২টির মধ্যে ৩ লাখ ৯৪ হাজার ৮৭টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৫টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।