অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা মানে জাতির ব্যর্থতা
পরাজিত ফ্যাসিস্টরা সমস্যা তৈরি করবে, ঐক্য ধরে রাখতে হবে
গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও তারা বসে নেই। তারা দেশকে নানাভাবে অস্থিতিশীল করে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। তাদের কাছে লুটপাটের প্রচুর টাকা রয়েছে। তারা আরও সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেগুলো মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। সমকালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া পরিবর্তিত বাস্তবতায় দেশের ভবিষ্যৎ, চ্যালেঞ্জ, নির্বাচন, রাজনীতি, বিএনপির লক্ষ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল হাসান
সমকাল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তিন মাস পার করলেও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এখনও একটি স্থিতিশীল পরিবেশ কেন আনা যাচ্ছে না বলে মনে করেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: বাংলাদেশকে ঘিরে সব সময় দেশি-বিদেশি চক্রান্ত কাজ করে। যে ফ্যাসিস্টরা পড়ে গেছে, পালিয়ে গেছে, তারা কিন্তু বসে নেই। একটা ভূরাজনীতির কারণে তারা আবার আসার চেষ্টা করছে। তাদের প্রচুর টাকা আছে; কত লুটপাট করেছে। কাজেই তারা এখানে আরও সমস্যা তৈরি করতে পারে। সেগুলো মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে।
সমকাল: বিএনপি আবার রাজপথে ফেরার কথা বলছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি বলেছেন, জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। এই আন্দোলনের ধরন কেমন হবে?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আমরা তো এখনও আন্দোলনের মধ্যে আছি। নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আছি। আমরা সম্মেলন করছি, রাস্তায় আছি, সমাবেশ করছি। এটা আন্দোলনের অংশ।
তবে আন্দোলন করছি মানেই সরকারের বিরোধিতা করছি না। বিরোধিতা করার সুযোগ এখন নেই। আমরা মনে করি, এখন তাদের সহযোগিতা করার সময়। এই সরকারকে আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত সহযোগিতা করব, যতক্ষণ পর্যন্ত মনে করব তারা জনগণের পক্ষেই আছে। এ ছাড়া আমরা খুব স্পষ্ট করে বলেছি, এই সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তারা যদি ফেল করে গোটা জাতি ফেল করবে। এই কারণে আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানো দরকার। তাহলে দূরত্বটা দূর হবে। কাজ করতে তাদেরও সুবিধা হবে, আমাদেরও হবে।
সমকাল: প্রশাসনে বহাল ফ্যাসিবাদ সরকার-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দ্রুত অপসারণের কথা বলছেন আপনারা। এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: প্রশাসনের বিষয়ে সরকার খুব ধীর। এটা আরও দ্রুত করা দরকার। এটি না হলে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। এখন যে অনেকে সরকারকে ব্যর্থ বলতে শুরু করেছে, এটার পেছনে একমাত্র কারণ এটিই। এ মানুষগুলোই ব্যর্থতার সৃষ্টি করছে। ব্যর্থতার সুযোগ নিচ্ছে।
সমকাল: আপনারা নির্বাচনকালীন রোডম্যাপ দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এখনও তা আসেনি। এ বিষয়ে আপনাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আমরা তো বলেছি, যৌক্তিক সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করব। সেই জায়গাতেই আছি। ইতোমধ্যে কাজ কিছুটা এগিয়েছে। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে। আমরা আশা করব, নির্বাচন কমিশন দ্রুত তাদের কাজগুলো করবে এবং একটি কার্যকর ও তাৎপর্যপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেবে। আমরা কখনোই ডেডলাইন দেইনি। তবে বলেছি, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সমকাল: রাষ্ট্রপতি অপসারণ এবং সংবিধান পরিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে এর বিরোধিতা করা হয়েছে। এর কারণ কী?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আমরা কখনও বিরোধিতা করিনি, আমরা আপত্তির কথা বলেছি। আমরা বলেছি, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আমরা না; জনগণ। আর রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে সংবিধানের প্রক্রিয়ার কথা বলেছি। রাষ্ট্রপতি ইনডিভিজুয়াল হেড অব স্টেট। ন্যাচারালি তাঁকে রেখেই সবাই শপথ নিয়েছেন। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসা ছাড়া কোনো প্রক্রিয়া হওয়া উচিত না।
সমকাল: বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্ক এখন কেমন? বিএনপি যে জাতীয় সরকারের কথা বলছে, সেখানে কি জামায়াত থাকবে?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: অন্য দলগুলোর সঙ্গে আগের যে কাজের সম্পর্ক, বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্কও তেমন। এখানে বলা প্রয়োজন, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি সম্পূর্ণ আলাদা দুটি সত্ত্বা। দুটি আলাদা দল; দুই দলের আদর্শও ভিন্ন। বিরোধী দলগুলো ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। এ কারণে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকা উচিত। আর জাতীয় সরকারে জামায়াত থাকবে কিনা তা নির্ভর করবে ওই সময়ে সম্পর্কের ওপর। যেহেতু আমরা বলেছি, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব দল নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করব। সে ক্ষেত্রে ওই সময়ের সম্পর্কের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সমকাল: তারেক রহমান বলেছেন, পরের নির্বাচন বিএনপির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। আপনি কী মনে করেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: নিঃসন্দেহে আগামী নির্বাচনে মানুষের প্রত্যাশা ভিন্ন হবে। এখন মানুষ পরিবর্তন চায়। তারা চায়, যাদের ভোট দেবে তারা যেন চলমান রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নতুন প্রত্যাশার সৃষ্টি করতে পারে। এটি বাস্তবায়নে সততা ও যোগ্যতা লাগে। এগুলো মানুষ দেখতে চায়। এখন বিএনপি নেতাকর্মীরা যদি মানুষের সামনে সেভাবে আসতে পারে তাহলেই কেবল সফলতা আনতে পারব। এ কারণেই তারেক রহমান ওই কথা বলেছেন।
সমকাল: প্রায়ই আপনি এক-এগারোর কথা বলেন, মাইনাস টু ফর্মুলার কথা বলেন। আপনি কি তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: মাইনাস টু এর মতো কোনো আশঙ্কা এখন আর দেখছি না।
সমকাল: তারেক রহমান কবে নাগাদ দেশে ফিরতে পারেন?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: সারাদেশে তাঁর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দেওয়া হয়েছিল। এসব মামলায় যখনই তিনি মুক্ত হবেন তখনই তিনি দেশে ফিরবেন।
সমকাল: একাধিক রাজনৈতিক দলের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সংসদের আসন বণ্টনের দাবির বিষয়ে আপনার মতামত কী? এ ছাড়া আপনারা দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের কথা বলেছেন– সেটি কেমন হবে?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের বিষয়ে আমরা একেবারেই একমত নই। এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। এই ব্যবস্থা সেসব দেশেই প্রযোজ্য, যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা অনেক উঁচুস্তরের। ইউরোপীয় দেশগুলোতে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন কাজে দেয়। তবে নেপাল এটি করলেও কাজে দিচ্ছে না। সেখানে বছরে বছরে সরকার ভেঙে যাচ্ছে। এটা আমাদের মতো দেশের জন্য কোনো স্থিতিশীল পদ্ধতি না। আর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে কাজ চলছে। আমরা মনে করি, আইন প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যদের সংসদে আসা প্রয়োজন। অনেক নারী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সংবাদকর্মী, সাহিত্যিক আছেন, যারা দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারেন কিন্তু নির্বাচনে আসেন না– তাদের জন্যই এই চিন্তা। এখানে আনুপাতিক হারে তাদের আনার ইচ্ছা আমাদের। একইভাবে বিভিন্ন দলের আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি নিয়োগের চিন্তাও আছে। যদিও এগুলো এখনও চূড়ান্ত নয়।
সমকাল: এ মুহূর্তে বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো কী বলে মনে করেন।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: বিএনপির প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব দেশকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরিয়ে আনা। ন্যূনতম সংস্কার শেষে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। এরপর বাকি সংস্কারগুলো শেষ করা।
সমকাল: ক্ষমতায় এলে বিএনপির বিদেশনীতি কী হবে? ভারতের সঙ্গে সম্পর্কই বা আগামীতে কেমন হবে?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয় একটা। আমরা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে চাই এবং রাখব। আর ভারত আমাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী দেশ– এটাই বাস্তবতা। স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সেভাবেই তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা হবে। তবে সেটা অবশ্যই দেশের স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
সমকাল: যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন কি?
মির্জা ফখরুল ইসলাম: নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে এর বিশাল প্রভাব আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে কে প্রেসিডেন্ট হলেন সেটি আমাদের মতো দেশে খুব একটা প্রভাব রাখে না। আমাদের এখানে এফেক্ট করে– আমরা কীভাবে রাজনীতিটা করছি তার ওপর।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মির্জা ফখরুল ইসলাম: আপনাদেরও ধন্যবাদ।