Hot

অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য সূচকে সবার নিচে বাংলাদেশ

দেশে কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া ও টাইফয়েডের মতো বিভিন্ন রোগে একসময় বহু মানুষের মৃত্যু হতো। স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসাব্যবস্থার অগ্রগতিতে বাংলাদেশ কিছু রোগ নির্মূল করেছে, কিছু রোগ নিয়ন্ত্রণে এনেছে। তবে সার্বিকভাবে স্বাস্থ্য অন্তর্ভুক্তির সূচকে অনেক পিছিয়ে আছে। লন্ডনভিত্তিক ইকোনমিস্ট গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট’-এর জরিপে এ রকম তথ্য পাওয়া গেছে।

‘ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট’-এর জরিপ অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) ছয়টি অঞ্চলের ৪০টি দেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্নে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্কোর (৩০.৮)। ৩৮.৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের আগে রয়েছে আলজেরিয়া। প্রথম অবস্থানে থাকা যুক্তরাজ্যের স্কোর হলো ৯০.৮।

এরপর আছে অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া ও সুইডেন। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্কোর হলো ৫২.৫ ও চীনের ৭০.৩।

চারটি উপাদানের ওপর ভিত্তি করে এই স্কোর দেওয়া হয়। ১. একটি দেশের কাছে জনস্বাস্থ্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, ২. রাষ্ট্রের সব নীতিতে স্বাস্থ্য কতটুকু স্থান পায়। ৩. আর্থিক সামর্থ্যের অভাবে স্বাস্থ্যসেবা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কি না। ৪. স্বাস্থ্যসেবা থেকে কোনো মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে কি না।

স্বাস্থ্যসেবার এমন প্রেক্ষাপটে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আজ রবিবার বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৪’।  দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘স্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিতে, কাজ করি এক সাথে’।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘আগে সরকারি হাসপাতালে ৮০ শতাংশ মানুষ সেবা নিত, আস্থা কমে আসায় সেখানে সেবা নেওয়ার হার ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।

নানা ভোগান্তি ও প্রতিবন্ধকতার কারণেই এই অনাস্থা। সেবা পাওয়া রোগীর অধিকার এটা সব ডাক্তার মনে করেন না। এ কারণে অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবায় পিছিয়ে বাংলাদেশ।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আরো বলেন, এবারের স্বাস্থ্য দিবসের যে প্রতিপাদ্য তা যদি যথাযথ প্রতিপালন করা যায়, তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। কারণ স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া  প্রতিটি মানুষের অধিকার। এটা অনুগ্রহ বা দয়া করার বিষয় না।

ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালকে জনগণের মনে করে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা শুধু অর্থ আয় করবেন তা নয়, রোগীদের মানসম্মত ও কল্যাণমূলক সেবাও তাঁদের নিশ্চিত করতে হবে।

অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ওষুধ লেখা বন্ধ করতে হবে। তাহলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবার পরিধি বাড়বে। একই সঙ্গে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অর্জনের সার্ভিস কাভারেজ ইনডেক্সে ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান স্কোর ৫২, যা ২০৩০ সাল নাগাদ কমপক্ষে ৮০-তে উন্নীত করতে হবে। স্বাস্থ্যে মোট ব্যয়ে ব্যক্তির নিজস্ব অংশ বর্তমানের ৬৮.৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে।

২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বৈশ্বিক স্বাস্থ্যনিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৩৫.৫। এ ক্ষেত্রে ১৯৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৫তম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক সূচকের অন্যতম বিষয় হচ্ছে একটি দেশে জনস্বাস্থ্যকে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। এই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান হলো সর্বনিম্ন। তার মানে, জনস্বাস্থ্যে গুরুত্ব দেওয়ার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে। এরপর জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাত প্রথম তিনটি বিষয়ের মধ্যে থাকছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত বাজেটের ১৫ শতাংশ। আমাদের হচ্ছে পাঁচ শতাংশ। কোনো সময় এর নিচেও নেমে যায়।’

সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, রাষ্ট্রের কোনো নীতিতে স্বাস্থ্য স্থান পায় না। বিদ্যুৎকেন্দ্র, রাস্তাঘাট,  ভবনসহ অবকাঠামো সব কিছুই হচ্ছে স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব না দিয়ে। এতে পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং হচ্ছে কিন্তু খেলার মাঠ নেই, পার্ক নেই, ফুটপাত নেই। থাকলেও তা ব্যবহারের উপযোগী নয়। সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল সবখানেই স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে জনগণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার চেয়েও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য ব্যয়ে ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হতো ৬৭ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার লক্ষ্য অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে এই ব্যয় ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। তবে কাজটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয়।

গতকাল শনিবার রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কনভেনশন হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনাসভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ জন্য দেশের প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত চিকিৎসা পৌঁছে দিতে হবে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি ঠিকভাবে কাজ করেন তাহলেই তা সম্ভব। আমি এ জন্য আপনাদের যত রকম সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তার ব্যবস্থা করব। আপনারা আমাকে সেবা দিন, আমি প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করব।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button