Bangladesh

অপরাধের স্বর্গরাজ্য কেরানীগঞ্জ

রাজধানীর কাছেই বর্ধিষ্ণু জনপদ কেরানীগঞ্জ। এই এলাকার জলাশয়, খালবিল দখল হয়েছে আগেই। এখন দখলবাজদের নজরে পড়েছে নদী আর সরকারি জমি। দখলের রাজত্ব কায়েম করতে প্রতিনিয়িত খুন হচ্ছে এই জনপদে। আধিপত্য বিস্তারে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে নানা বাহিনী। মাদক ব্যবসার রমরমা হাট বসে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রশ্রয়ে নতুন নতুন হাউজিং গড়ে তুলে সাধারণ মানুষের জমি একপ্রকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এই এলাকার শতকরা ৮০ ভাগ অপরাধই সংঘটিত হচ্ছে ভূমিদস্যুদের হাতে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, সরকারি কর্মকর্তরাও রেহাই পান না ভূমিদস্যুদের হাত থেকে। এদের প্রতিপালন করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

সামান্যজমিকিনেইচলেদখলদারিত্বেরথাবা

সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বিভিন্ন জায়গায় চলছে মাটি কাটাকাটি। কার জমি কে কাটছে বোঝা দায়। চাষের জমি থেকে শুরু করে নদী, খালসহ সব জায়গা থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, কোনো একটি হাউজিং কোম্পানি সামান্য জায়গা কিনে চালায় দখলদারিত্বের থাবা। প্রকৃত মালিকেরা জমি বিক্রি করতে রাজি না হলে ভূমিদস্যুদের আছে নানা বাহিনী। এসব বাহিনী ভূমিদস্যুদের পক্ষে ভাড়ায় খাটে।

এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় জয়নাল, কামরুল, বাদল মেম্বার, হালিম খাঁ, শাহ আলম খাঁ, বাপ্পি, জসিম গংরা রাতের আঁধারে ভেকু দিয়ে জমি ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর করে মাটি বিক্রি করে দেন। পরে জমির মালিকদের কম দামে হাউজিংয়ের কাছে জমি বিক্রি করতে বাধ্য করে। এদের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় একাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় তারা এসব কাজ করলেও মামলা থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রেফতার করা হচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন দখলদারি ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে র্যাব-১০-এর কার্যালয়ে অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। সেগুলোরও সুরাহা হয়নি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের কারণে অনেক অভিযোগ ধামাচাপা পড়ে যায়।

 ভূমি দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়। তিন বছর পার হলেও এই নির্দেশনা আলোর মুখ দেখেনি। ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রেহাই পাননি পুলিশ কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান, অ্যাডভোকেট মুক্তা, অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান, অ্যাডভোকেট শামিমা আক্তার শিউলি, সেনা কর্মকর্তার মেয়ে হোসনে আরা স্বপ্নাসহ শত শত পরিবার। তারা স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে বিচার না পেয়ে বোবা কান্না করছেন।

রাজনৈতিকছত্রছায়ায়চলেবাহিনী, বাড়ছেখুন

নানা বাহিনীর অত্যাচারে সেখানকার মানুষ অতিষ্ঠ। এসব বাহিনী চলে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। কোনো কোনো বাহিনীর প্রধান স্থানীয় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির নিকটাত্মীয়। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আলোচিত রাসেল হত্যাকাণ্ডের পর বিষয়টি সবার সামনে আসে। কথিত আব্বা বাহিনীর সদস্যরা এই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

আলোচিত এই আব্বা বাহিনীর প্রধান হচ্ছেন ঐ জনপ্রতিনিধির ছোট ভাইয়ের শ্যালক রাব্বি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। তার বাবা শুভাঢ্যা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। শ্বশুর ইকবাল হোসেন শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। অপর এক চাচা হাজি সাকুর হোসেন সাকু জিনজিরা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এবং জিনের বাদশা মজিবর।

স্থানীয়রা জানান, তারা স্থানীয় ডিবি পুলিশ ও প্রশাসনের আশ্রয়ে প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কালীগঞ্জ তেলঘাট এলাকায় তিনটি টর্চার সেল তৈরি করেন। তারা বুড়িগঙ্গা নৌপথের বিভিন্ন নৌযান থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি করতেন। কালীগঞ্জে ডকইয়ার্ড থেকে জাহাজ ওঠানামার জন্য নেওয়া চাঁদার টাকার ভাগাভাগি নিয়েই মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও রাব্বির দীর্ঘদিনের বন্ধু সাইফুল ইসলাম রাসেলকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুব আলম সুমন জানান, দ্রুততম সময়ে রাসেল হত্যা মামলা তদন্ত করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হবে। স্থানীয় পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, কেরানীগঞ্জে গত দুই বছরে আলোচিত রাসেল হত্যাসহ ১৭টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। ডাকাতি হয়েছে ৭৪টি, ৩টি স্বর্ণের দোকান লুটসহ ছিনতাই হয়েছে ১৭০টি। চাঁদা ও মুক্তিপণের ঘটনা ঘটেছে ২৬টি। ধর্ষণ হয়েছে ১৮টি।

চাঁদাছাড়াচলেনাঅটোরিকশাও

কেরানীগঞ্জের অটোরিকশাচালকেরা আছেন বিপদে। আয় হোক আর না হোক, চাঁদা তাদের দিতে হয়। এলাকার হাসনাবাদ, কদমতলীসহ সাতটি স্ট্যান্ডের মাধ্যমে প্রায় ৯ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ৭ হাজার ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করে। এলাকার ২৫ জন চাঁদাবাজ বিশেষ স্টিকার ব্যবহার করে এসব অটোরিকশা থেকে দৈনিক ভিত্তিতে টাকা আদায় করে।

জমা পরিশোধ (জিপি) নামক স্টিকার দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় অটোরিকশাচালকদের কাছ থেকে ৭৫ টাকা এবং রিকশাচালকদের কাছ থেকে ৩০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে গত বছরের নভেম্বর মাসে চাঁদাবাজদের ধরতে র্যাব সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে।

সে সময় বেশ কয়েক জন চাঁদাবাজ গ্রেফতার হলেও অভিযানে ভাটা পড়ায় আবারও পুরোনো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এসব চাঁদাবাজ বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় থেকে পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রশাসন তাদের পক্ষে থাকায় কেউ মামলা করারও সাহস পায় না।

ঢাকার কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ থানা ও কেরানীগঞ্জ মডেল থানা এলাকায় বিভিন্ন নামধারী চাঁদাবাজ পুলিশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে বুড়িগঙ্গা নদী, জাহাজশিল্প ও তৈরি পোশাকশিল্প এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যাপক চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী। তাছাড়া থানার পুলিশের সমর্থন পেয়ে থানার সোর্সরাও বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button