Bangladesh

অপ্রতিরোধ্য যাত্রায়ও চ্যালেঞ্জ, ঐতিহ্যের ৭৫ বছরে আওয়ামী লীগ

আজ ঐতিহাসিক ২৩ জুন। উপহমাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (প্লাটিনামজয়ন্তী)।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জনগুলোতে রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। পৃথিবীর খুব কম রাজনৈতিক দল আছে যারা ধারাবাহিক সাফল্য নিয়ে ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছে।

তবে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ৭৫ বছরের এ পথচলা এত সহজ ছিল না। ষড়যন্ত্র, হত্যা, খুন ও গুমের শিকার হয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নির্যাতন ও হত্যার টার্গেট হয়েছে বারবার।

জাতির পিতার স্বপ্নের পথ ধরে তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৮১ সালে শুরু হয় আওয়ামী লীগের নতুনযাত্রা। তার সফল নেতৃত্বে আজকের আওয়ামী লীগ এগিয়ে চলছে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায়। টানা চতুর্থবারসহ পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতায় দলটি।

রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সামনের দিনগুলোতেও নানা চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক দেশ গঠন, দুর্নীতিমুক্ত করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা বাস্তবায়ন, দলকে তৃণমূল পর্যন্ত আরও সুসংগঠিত করা হবে দলটির জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রতিবছরের মতো এবারও আওয়ামী লীগ বিস্তারিত কর্মসূচির মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।

বাণীতে তিনি বলেন, হাজার বছরের শাসন-শোষণের ইতিহাস মুছে ফেলে বাঙালি জাতির চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগঠনটিকে প্রস্তুত করতে শেখ মুজিবকে যেমন অসংখ্য চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। তেমনি তার ব্যক্তিজীবনকেও বিসর্জন দিতে হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত বাঙালির অর্জন এবং বাংলাদেশের সব উন্নয়নের মূলেই রয়েছে আওয়ামী লীগ।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে পুরো বিশ্ব নানা সংকটের মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সংকট চলছে। যুদ্ধ চলছে। সংকট বাংলাদেশেও রয়েছে। বিশেষ করে বেকার সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা। এসব সমস্যা কিন্তু আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে।

এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি এই সংকট মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে। এটাই আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে অঙ্গীকার।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আওয়ামী লীগ সব সময় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রাজনীতি করে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই এই দল আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কাজেই ৭৫ বছর পরও আওয়ামী লীগের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আওয়ামী লীগ এগিয়ে যাবে এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠন করবে। এটাই আমাদের অঙ্গীকার

দীর্ঘ পথচলা: আওয়ামী লীগের শুভজন্মদিন ঐতিহাসিক ২৩ জুন অঙ্কুরিত হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নসূত্র’। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শুধু দেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠনই নয়, বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারাও।

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও আওয়ামী লীগের ইতিহাস একসূত্রে গাঁথা। ১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে গণজাগরণে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে সম্পূর্ণ পৃথক দুটি ভূখণ্ড, স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতির অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪ মাস ২০ দিনের মধ্যে তখনকার তরুণ যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠন করেন সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠন পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।

এরই ধারাবাহিকতায় পরের বছর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার স্বামীবাগে কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে আয়োজিত কর্মী সম্মেলনে গঠন করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমানকে (কারাবন্দি ছিলেন) যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় আওয়ামী (মুসলিম) লীগের প্রথম কমিটি।

১৯৫৫ সালে এই দল ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। দলের নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’

মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান শব্দটি বাদ দিয়ে দলটি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। এই আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে স্বাধিকার আদায়ের জন্য ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। সেই ৬ দফা আন্দোলনের পথ বেয়েই ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সফল নায়ক ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলটিকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর অনেকটা অস্তিত্ব সংকটেই পড়ে আওয়ামী লীগ। দলের ভেতরেও শুরু হয় ভাঙন।

এর মধ্যে আবদুল মালেক উকিল-জোহরা তাজউদ্দীনের দৃঢ়তায় সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করে দলটি। ১৯৮১ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে ফিরে এক দশক ধরে সারা দেশ ঘুরে দলকে সংগঠিত করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বেই ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করে দলটি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের রায় কার্যকর হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের রায়ও কার্যকর হয়েছে, সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পথ বন্ধ করা হয়েছে।

এই সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পথপরিক্রমায় অনেক বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছে ‘ভাত ও ভোটের’ অধিকার। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, স্থিতিশীল অর্থনীতি, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, উন্নয়নে গতিশীলতা, ডিজিটাল বাংলাদেশ, শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়নের ফলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় জমিসহ ঘর উপহার দিচ্ছে। যা ইতিহাসে বিরল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, থার্ড টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প দৃশ্যমান হয়েছে।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষি, স্বাস্থ্য খাতের অগ্রগতি, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক ও যোগাযোগব্যবস্থাসহ ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, দুর্যোগ, বন্যাসহ দেশে যে কোনো দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সব সময় দেশের পাশে থেকেছে আওয়ামী লীগ।

নিত্যপণ্য ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্র্নির্মাণ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, শীতবস্ত্র বিতরণ, উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ সংরক্ষণ ও মজবুতকরণসহ নানা পদক্ষেপ নিয়ে মানুষের পাশে ছিল আওয়ামী লীগ।

কর্মসূচি : ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে ১০ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। আজ রোববার সূর্য উদয়ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৭টায় ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন. সকাল সাড়ে ১০টায় টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, ২টা ৩০ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন, বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে।

বিভিন্ন দলকে আমন্ত্রণ, যাবে না বিএনপি : আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আলোচনা সভায় দেশের সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির ৬ সিনিয়র নেতাকে আমন্ত্রণ জানান ক্ষমতাসীনরা। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো নেতা সমাবেশে অংশ নেবেন না বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমন্ত্রণ পাওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা জানান, ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই সময়ে গুম-হামলা-মামলা ও নির্যাতনের শিকার বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী। চেয়ারপারসন থেকে শুরু করে এমন কোনো নেতাকর্মী নেই যার বিরুদ্ধে মামলা নেই। সেই দলের সমাবেশে নেতারা যেতে পারেন না। তাছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে যেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, সেখানে কারও যাওয়ার কথা নয়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button