Bangladesh

অপ্রয়োজনে আট স্থলবন্দর, গচ্চা সাড়ে চারশ কোটি টাকা

মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি স্থলবন্দর। ওই তিনটি বন্দরের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৬০.৪ একর জমি। সেখানে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় হয়েছে অন্তত ১৪৩ কোটি টাকা। অথচ এই তিনটি স্থলবন্দর চলছে ঢিমেতালে। পণ্য না থাকায় কখনো কখানো বন্দর কার্যক্রম বন্ধ থাকে। যদিও এসব বন্দরে রাজস্ব বিভাগ, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত অবস্থান করতে হয়। এ পর্যন্ত এই তিন স্থলবন্দর থেকে ২০ কোটি টাকাও আয় হয়নি কর্তৃপক্ষের। ওই তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণের নেপথ্যে ছিলেন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তিনজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী এবং এক মুখ্য সচিব।

বন্দর তিনটি হচ্ছে-শেরপুরের নাকগাঁও, ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী এবং জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই তিন জেলায় একটি অথবা সর্বোচ্চ দুটি স্থলবন্দরই যথেষ্ট। সেখানে তিনটি স্থলবন্দর নির্মাণ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় মাত্র তিন কিলোমিটার ব্যবধানে গোবড়াকুড়া ও কড়ইতলী নামে দুটি পৃথক শুল্ক স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও এ দুটি টার্মিনালের বিপরীতে ভারতের মেঘালয়ে একটি মাত্র স্থলবন্দর রয়েছে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে সারা দেশে আটটি স্থলবন্দরের তথ্য পাওয়া গেছে, যেগুলো দেশের মানুষের উপকারে তেমন কাজে আসছে না। এসব বন্দরকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে জানিয়েছেন স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা। প্রভাবশালীদের তদবির বা চাপে সেগুলোকে বন্দর ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ওই আটটি স্থলবন্দরের মধ্যে ছয়টির কার্যকারিতা নেই। কয়েকটির ভারতীয় অংশে কোনো স্থাপনাও নেই। অথচ এসব স্থলবন্দর নির্মাণে এ পর্যন্ত অন্তত সাড়ে চারশ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। প্রায় ৮৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। নির্মাণ করেছে বিশাল বিশাল অবকাঠামো। স্থলবন্দর হিসাবে ব্যবহার না থাকায় এসব অবকাঠামো এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওই আট স্থলবন্দর হচ্ছে-খাগড়াছড়ির রামগড়, রাঙামাটির তেগামুখ, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ, নীলফামারীর চিলাহাটী, হবিগঞ্জের বাল্লা, দিনাজপুরের বিরল, জামালপুরের ধানুয়া-কামালপুর এবং ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী। দিনাজপুরের বিরল ছাড়া বাকি সাতটি স্থলবন্দর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তৈরি। বিরল স্থলবন্দর বিএনপির আমলে ঘোষণা করা হয়। ওই বন্দর উন্নয়ন করেছে বেসরকারি অপারেটর।

অপ্রয়োজনীয় স্থলবন্দরের বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর জানতে পারলাম অনেক স্থলবন্দর জনগণের উপকারে আসছে না। অথচ সেখানে বিপুল পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। ওইসব বন্দর এখন দেশের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, যেসব বন্দর মানুষের কাজে লাগছে না, সেগুলোর বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করে দিয়েছি। ওই কমিটিতে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি আছেন। ওই কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

দেশের সীমান্তে ২৪টি স্থলবন্দর আছে। এর মধ্যে ২৩টি ভারতের সঙ্গে এবং একটি (টেকনাফ) মিয়ানমারের সঙ্গে রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি সচল এবং বাকি ৮টি চালুর অপেক্ষায় ।

সড়ক নেই তবুও তেগামুখ স্থলবন্দর : নেই সড়ক যোগাযোগ। দুর্গম এলাকা। যাতায়াতের মাধ্যম হেলিকপ্টার ও নৌপথ। তবুও ২০১৩ সালের ৩০ জুন তেগামুখকে স্থলবন্দর ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। এটি রাঙামাটির বরকল উপজেলায় অবস্থিত। রাঙামাটি সদর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এ বন্দরের বিপরীতে রয়েছে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের কাউপুঁচিয়া সীমান্ত । এ বন্দর স্থাপনে ভারতের আগ্রহ ছিল। ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় ভারতীয় পণ্য নৌপথে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে তা এ বন্দর হয়ে সহজেই মিজোরাম রাজ্যে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক সূত্র জানায়, পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং গওহর রিজভী এ বন্দর চালুর পদক্ষেপ নিতে সংস্থাটির কর্মকর্তাদের চাপ দিতেন। তাদের চাপের মুখে এ বন্দর ঘোষণা করা হয়। যদিও পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের আপত্তির কারণে এ বন্দরে অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারেনি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। তবে ভারত তার অংশে ২১ একর জমি অধিগ্রহণ ও সমীক্ষা করেছে। বর্তমানে ওই দুজন উপদেষ্টা বাংলাদেশে নেই।

সব অবকাঠামো আছে বাল্লা স্থলবন্দরে, ভারতের অংশে কিছু নেই : জানা গেছে, ওয়্যারহাউজ, ট্রান্সশিপমেন্ট ইয়ার্ড, ট্রাক পার্কিং ইয়ার্ড, ওপেন ইয়ার্ড, প্রশাসনিক ভবন, ডরমিটরিসহ একটি বন্দরের কার্যক্রম চালানোর সবকিছুই আছে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় অবস্থিত বাল্লা স্থলবন্দরে। এসব স্থাপনা নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছে ৪৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৩ একর। ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ শুল্ক স্টেশনকে বাল্লা স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। এই স্থলবন্দরের বিপরীতে ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়মুড়ায় বন্দর স্থাপন করেনি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ স্থলবন্দর নির্মাণের নেপথ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের বেসামরিক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এবং নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব অশোক মাধব রায়।

বর্তমানে মাহবুব আলী কারাগারে। আর অশোক মাধব রায় যুগান্তরকে বলেন, ২০১২ সালে দুই দেশের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ স্থলবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমি নৌ সচিব থাকাবস্থায় কিছু কাজ করেছি। ২০১৬ সালে অবসর নেওয়ার পর মূল উন্নয়ন কাজ হয়েছে।

২৭৫ কোটি টাকার অবকাঠামো পড়ে আছে রামগড় স্থলবন্দরে : খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলায় পড়ে আছে সুদৃশ্য ১২ হাজার বর্গফুট আয়তনের আন্তর্জাতিক যাত্রী টার্মিনাল। রয়েছে সীমানা প্রাচীর, ওয়্যারহাউজ, অফিস ভবন, ট্রান্সশিপমেন্ট শেডসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। বিশ্বব্যাংক ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ রিজিওনাল কানেকটিভি প্রকল্প-১ এর আওতায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। প্রায় ৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১০ একর জমি। ট্রান্সশিপমেন্টের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা পণ্য এ স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাওয়ার সুবিধার্থে এ বন্দর নির্মাণ করে সরকার। আলোচিত ফেনী নদীর ওপর রামগড়-সাবরুম এলাকায় সেতুও নির্মাণ করেছে ভারত। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক সূত্র জানায়, এটি বাংলাদেশের মানুষের কাজে আসবে না। ট্রান্সশিপমেন্টের পণ্য পরিবহণের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়। তবে সেটি চালু হয়নি।

৮-১০ কিলোমিটার ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় দুই স্থলবন্দর : চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর ও দামুড়হুদা এই দুই উপজেলা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা-২ সংসদীয় আসন গঠিত। পাশাপাশি অবস্থিত এই দুই উপজেলায় দুটি পৃথক স্থলবন্দর ঘোষণা করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। একটি জীবননগর উপজেলার দৌলতগঞ্জ আরেকটি দামুড়হুদা উপজেলা দর্শনা স্থলবন্দর। সড়ক পথে দুটি স্থলবন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার। এ দুটি স্থলবন্দরের একটিও আজ পর্যন্ত চালু হয়নি।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ-সদস্য আলী আজগর টগরের প্রভাবে ২০১৩ সালের ৩১ জুলাই দৌলতগঞ্জ শুল্ক স্টেশনকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। অথচ দৌলতগঞ্জের বিপরীতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মাজদিয়া শুল্ক স্টেশনের কোনো কার্যক্রমই নেই। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেওয়া হলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ওই স্টেশন কার্যকরে সম্মতি জানায়নি। এ কারণে এ বন্দর ঘোষণাতেই আটকে আছে। অপরদিকে দর্শনা স্থলবন্দরের জমি অধিগ্রহণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে রেলওয়ের মাধ্যমে এ বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে।

স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর থাকার পরও চুয়াডাঙ্গায় এ দুটি স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। এগুলোর কার্যকারিতা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

স্থলবন্দর একটি, শুল্ক স্টেশন দুটি : ভারতের মেঘালয় রাজ্যে গাছুয়াপাড়ায় একটি শুল্ক স্টেশন। বিপরীতে বাংলাদেশেও একটি শুল্ক স্টেশন হওয়ার কথা। কিন্তু প্রয়াত সাবেক সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিনের প্রভাবে শুল্ক স্টেশন হয়েছে দুটি। যদিও স্থলবন্দর একটি। সেটি হচ্ছে-গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর। মাত্র তিন কিলোমিটার দূরত্বে গোবড়াকুড়া ও কড়ইতলীতে পৃথক এ দুটি শুল্ক স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্থলবন্দরের জন্য ৩১.১৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ব্যয় হয়েছে ৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে মাত্র ৯৬৪ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। এতে আয় হয়েছে মাত্র এক কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে পরিচালন ব্যয় হয়েছে এক কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা এটিকেও অপ্রয়োজনীয় বন্দর মনে করছেন।

ধানুয়া-কামালপুর : নাকুগাঁও এবং গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী দুটি স্থলবন্দরের ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি স্থলবন্দর হচ্ছে ধানুয়া-কামালপুর। জামালপুরের বকশীগঞ্জে অবস্থিত এ স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য ৪৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ১৫.৮০ একর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বন্দর দিয়ে মাত্র ২৪৫৫২ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। রপ্তানি হয়েছে যৎসামান্য। এ বন্দর থেকে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত এক কোটি টাকাও আয় করতে পারেনি। জানা গেছে, সাবেক তথ্যমন্ত্রী জামালপুর-১ আসনের সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব ও জামালপুর-৫ আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদের প্রচেষ্টায় এটিকে স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে কারাগারে ।

চিলাহাটি : সড়কপথে পণ্য আমদানি ও রপ্তানির অনুমতি দেয়নি ভারত। তবুও নীলফামারীর ডোমরা উপজেলায় চিলাহাটি স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালে। এর নেপথ্যে ছিলেন সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। এখন পর্যন্ত এ বন্দরে রেলপথে পণ্য আসা-যাওয়া করছে। এই স্থলবন্দরটিকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor