অবরোধে অনিশ্চিত গন্তব্যে দেশ
টানা অবরোধে অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে দেশ। নমনীয়তা দেখাচ্ছে না বিরোধী দলগুলো। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে তিন দিনের অবরোধের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চসহ সমমনা দলগুলো রোববার থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে। দাবি না মানতে অনড় সরকার। বিরোধীদের ঠেকাতে আওয়ামী লীগ রয়েছে কঠোর অবস্থানে।
অবরোধে দূরপাল্লার বাস প্রায় বন্ধ থাকায় জনজীবন অনেকটাই থমকে গেছে। পণ্যবাহী যান চলাচল কমে যাওয়ায় ব্যবসা, কৃষি, শিল্পসহ সব খাতই কমবেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে দ্রব্যমূল্য আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষ আরও চিড়েচ্যাপ্টা হতে পারেন। স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটছে। বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য বার্ষিক পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষক ও অভিভাবকরা।
গত শনিবার বিরোধী দলগুলোর মহাসমাবেশের দিন থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সহিংসতায় পুলিশসহ অন্তত আটজনের প্রাণ গেছে। চারজন নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে। বিএনপি ও জামায়াতের দাবি অনুযায়ী নিহতের সংখ্যা ১১। হরতাল-অবরোধ সমর্থকরা শতাধিক যানবাহনে আগুন দিয়েছে এবং ভাঙচুর চালিয়েছে।
তবে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, হরতাল ও অবরোধের চার দিনে ঢাকায় ২৭টি বাসে আগুন দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বাইরে ১৮টি যানবাহনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, অবরোধের তিন দিনে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৩১টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে; এর মধ্যে বাস ১৮টি।
এ পরিস্থিতির মধ্যে গতকাল খবর এসেছে, অক্টোবরে আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও অবনতির শঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, যা হচ্ছে, দেশের ক্ষতি হচ্ছে, কারও লাভ হচ্ছে না। নির্বাচনের পরিবেশও নষ্ট হচ্ছে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর টানা অবরোধের কর্মসূচিকে সমাধান মনে করেন না জাফরউল্লাহ।
হরতাল-অবরোধ ঠেকাতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সড়কে রয়েছে। কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, একে সর্বোত্তম উপায় বলব না। তবে এ ছাড়া পথও নেই।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী মনে করছেন, বিরোধীদের কর্মসূচিতে জনসমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, জনগণ সমর্থন জানিয়েছে বলেই আমরা একের পর এক কর্মসূচি সফল করছি। জামায়াতের এক কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সরকার একতরফা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত থেকে না সরলে ভোটের পরও চলবে অবরোধ। অর্থাৎ আগামী কয়েক মাস চলবে অবরোধ। ২০১৫ সালে টানা তিন মাস অবরোধ কর্মসূচি চলেছিল।
বিএনপি জানিয়েছে, ২৭ অক্টোবর থেকে ৯৬টি মামলায় চার হাজার ৫৫৫ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের হামলায় আহত হয়েছেন ৩ হাজার ৪৭৬ জনের বেশি। জামায়াত জানিয়েছে, ১ হাজার ২৮৪ জনের বেশি নেতাকর্মীকে আটক-গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আহত শতাধিক। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ৬৪ মামলায় প্রায় ২ হাজার ২০০ নেতাকর্মীকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলো বলছে, সরকার ধরপাকড় ও হামলা করে সমঝোতার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগের ভাষ্য, ২৮ অক্টোবরের সহিংসতাকারীদের ধরা হচ্ছে। গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ছাড় দেওয়া হবে না।
এ ব্যাপারে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ২৮ অক্টোবর যে সংঘাত শুরু হয়েছে, এর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোলা রাখেনি রাজনৈতিক দলগুলো। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিদেশি শক্তিগুলো বাংলাদেশে এসে ঔদ্ধত্যপূর্ণ স্বরে কথা বলছে, যা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি। রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতৈক্য না থাকায় বিদেশি শক্তিগুলো সুযোগ নিচ্ছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সামনে আরও অন্ধকার। আলোর দেখা মিলবে– এমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করলে তা জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে।
তবে সমাধানের পথ দেখা যাচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক উত্তাপে শঙ্কা আরও বাড়ছে। গতকাল অবরোধের তৃতীয় দিনে ঢাকা শহরে বাস ও প্রাইভেট গাড়ির চলাচল বাড়লেও যাত্রী ও চালক সবাই রয়েছেন আতঙ্কে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়া মানুষের সংখ্যা কম। যাত্রী সংকটে গাবতলী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে আগের দুই দিনের মতোই দিনের বেলায় দূরপাল্লার বাস ছেড়েছে হাতেগোনা।
তবে অবরোধ শেষে সন্ধ্যার পর বাস ও যাত্রীর ঢল নামে। সায়েদাবাদে বিভিন্ন পরিবহনের সমন্বিত কাউন্টারের ব্যবস্থাপক সানি মিঞা জানান, অন্য সময় আধাঘণ্টা পরপর একটি বাস ছাড়ত। যাত্রী সংকটে এখন একটি বাসের সব আসন পূর্ণ হতে তিন-চার ঘণ্টা পর্যন্ত লাগছে।
গাড়ি চালাতে নিরাপত্তা চেয়ে আগের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠকের পর গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বসেন পরিবহন মালিক-শ্রমিক নেতারা। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যানবাহন অবরোধে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। আগামী রোববার থেকে মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের সময় পাহারায় থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেদিন থেকে নিশ্চিতভাবেই যান চলাচল বাড়বে। অবরোধের প্রথম দফায় দূরপাল্লার বাস প্রায় বন্ধ থাকার বিষয়ে খন্দকার এনায়েত বলেন, যাত্রী সংকটে এ পরিস্থিতি হয়েছিল। রোববার থেকে কেউ বাস বন্ধ রাখবে না।
পণ্যবাহী যান চলাচলেও স্থবিরতা তৈরি রয়েছে। কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, পণ্যবাহী মালিক সমিতির তথ্য অনুযায়ী, আগে তেজগাঁও থেকে দিনে পাঁচ হাজার ট্রিপ হতো। করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গার্মেন্ট পণ্য কারখানাগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিবহন করায় ট্রিপের সংখ্যা হাজারের নিচে নেমেছে। হরতাল-অবরোধের কারণে এখন দিনে ১০০ ট্রিপও হচ্ছে না। বহু গাড়ি মাসেও একটি ট্রিপ পাচ্ছে না। সমিতির সভাপতি তোফাজ্জল হোসেন জানান, ব্যবসা দিন দিন বন্ধের পথে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন কৃষক। উঠতে শুরু করা শীতের নতুন সবজির পরিবহন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। গতকাল ঈশ্বরদীতে পাবনা-রাজশাহী মহাসড়কে কাঁচা সবজি ঢেলে হরতাল-অবরোধবিরোধী বিক্ষোভ মিছিল করেছেন কৃষক। পরিবহন ব্যবস্থায় স্থবিরতার কারণে ধান, আলু, সবজি, দুধ, ফলসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্যের দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গতকাল মধ্যরাত থেকে সাগরে মাছ ধরা শুরু হলেও বিপণনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সহসভাপতি ড. যশোধা জীবন দেবনাথ বলেন, দেশের অর্থনীতির আকার ৪৫০ বিলিয়ন থেকে ট্রিলিয়ন ডলারে নিতে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে ব্যবসায়ী সমাজ। করোনা-পরবর্তী সমস্যা উত্তরণের আগেই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, এর পর ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধের প্রভাবে ব্যবসায়ীরা ক্রান্তিকাল পার করছেন। নানা জটিলতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে আমদানি-রপ্তানিতে। বিনিয়োগকারীরা যখন এ সমস্যা মোকাবিলায় লড়ছেন, তখন বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধে ব্যবসায়ীরা বেশ আতঙ্কিত। অবরোধে পণ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এতে দাম বেড়ে যায়, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। ব্যবসায়ী সমাজ হরতাল-অবরোধ নয়, ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। এক দিনের অবরোধে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি অপূরণীয়।
মানুষের ক্ষতি হলেও হরতাল-অবরোধকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি আদায়ের পথ মনে করছে বিএনপি ও সমমনারা। আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ‘ধরে রাখতে’ প্রাণহানি যাতে না হয়, সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছে দলগুলো। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে থাকা বিএনপির নেতাদের কয়েকজন সমকালকে বলেন, মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার প্রতিবাদে ডাকা হরতালে জনগণের সমর্থন ছিল। অবরোধেও জনসমর্থন দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবি, সে কারণেই মানুষ রাস্তায় নামছে কম।
কাজী জাফরউল্লাহ বলেন, ‘দেশের ক্ষতি হচ্ছে হরতাল-অবরোধে। রপ্তানি এমনিতেই কমে যাচ্ছে। অবরোধের প্রভাব টের পাওয়া যাবে আরও পরে। ক্ষতির শিকার হবে নির্বাচন। এর নিরসন হওয়া দরকার।’ কীভাবে নিরসন হতে পারে প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই জ্যেষ্ঠ নেতা বলেন, ‘বিভিন্ন পথ আছে। আলোচনাও একটি পথ।’ তবে তিনিও বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে– এ শর্তে আলোচনা হতে পারে।