অবশেষে দুদকের জালে সেই প্রাসাদের ‘রাজা-রানি’
প্রতারণা ও দখলবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে গাজীপুরের নিভৃত গ্রাম পাজুলিয়ায় গড়ে তুলেছিলেন এক রাজপ্রাসাদ। যেখানে বৃদ্ধা মায়ের ঠাঁই না হলেও রাজা-রানির মতো বিলাসী জীবন যাপন করছিলেন শহীদুল ইসলাম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী নাজনীন চৌধুরী।
অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে ধরা পড়লেন তাঁরা। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে আলাদা দুটি মামলা হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানেও মিলেছে তাঁদের প্রতারণা ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য।
জানা গেছে, শহীদুল ইসলাম সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কম্পানি লিমিটেডের সাবেক কর্মী। দুদকের গাজীপুর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সেলিম মিয়া বাদী হয়ে গত ১৮ মার্চ শহীদুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন। এতে মোট পাঁচ কোটি ১৩ লাখ ৪১ হাজার ৪৫৭ টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় অভিযোগ করা হয়।
এর আগে ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর শহীদুলকে নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে ছেলে রাজপ্রাসাদে, মা আজও চা দোকানি’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে শহীদুলের দুর্নীতি ও প্রতারণার ঘটনা প্রকাশিত হয়। উঠে আসে শহীদুলের সাধারণ মানুষকে ঠকানো, প্রতারণা, জালিয়াতির মতো অভিযোগ।
কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মূলত ইনস্যুরেন্স কর্মী হলেও এলাকায় কখনো সচিব, আবার কখনো সচিবালয়ের বড় কর্তার পরিচয় দিয়ে আসছিলেন তিনি। একসময় গ্রামের সাধারণ মানুষের ইনস্যুরেন্সের অর্থ আত্মসাৎ করে গা-ঢাকা দেন। পরে রাজধানীতে বিভিন্ন সরকারি কাজ বাগিয়ে কমিশন বাণিজ্য শুরু করেন। এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে তিনি নিজে ছাড়াও স্ত্রী, শ্যালক ও শ্বশুরের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন।
কালের কণ্ঠ’র প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, শহীদুল গাজীপুরের পাজুলিয়ায় প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চারতলা বিলাসবহুল একটি ভবন নির্মাণ করেন।
কিন্তু সেই প্রাসাদে ঠাঁই হয়নি তাঁর মায়ের। মা তখনো দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে চালিয়ে আসা একটি চা দোকান চালিয়ে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করছিলেন।
ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর টনক নড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন সংস্থার। তাদের অনুসন্ধানেও শহীদুলের দুর্নীতি তথা অবৈধ সম্পদের খোঁজ পাওয়া যায়। তবে দুদকের অনুসন্ধানে পাওয়া অবৈধ সম্পদের চেয়ে তার প্রকৃত সম্পদ কয়েক গুণ বেশি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, শহীদুল ইসলাম চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী নাজনীন চৌধুরীর সম্পদের তথ্য চেয়ে সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করে দুদক। গত বছরের ৫ মার্চ তাঁরা সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে মোট ৪০ লাখ ৫১ হাজার ১৬০ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন, ৩৭ লাখ ৩৪ হাজার ২৮৮ টাকা জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পায় অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। উক্ত জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও দখলে রাখা এবং সম্পদের তথ্য গোপনের অপরাধে শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারায় মামলা করা হয়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, অনুসন্ধানকালে শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর স্ত্রী নাজনীন চৌধুরীর নামে ৭১.৭৫ শতাংশ জমি, এক হাজার ৫৪০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট এবং প্রাসাদোপম চারতলা একটি বাড়িসহ চার কোটি ৭৬ লাখ সাত হাজার ১৬৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। মূলত শহীদুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর সম্পদের উৎস আড়াল করার উদ্দেশ্যে স্ত্রীর নামে এই বিপুল সম্পদ করেছেন বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে।
অনুসন্ধান সূত্র জানায়, নাজনীন চৌধুরী নিজ নামের সম্পদের তথ্য গোপন করার উদ্দেশ্যে তাঁর বাবার কাছ থেকে বিভিন্ন সময় হেবা দলিল করিয়ে নিলেও দুদকের অনুসন্ধানে তা ভুয়া প্রমাণিত হয়। এর ফলে তাঁর বিরুদ্ধে তিন কোটি ৫৪ লাখ ১৭ হাজার ১৬৯ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং চার কোটি ৭৬ লাখ সাত হাজার ১৬৯ টাকার জ্ঞাত আয়ের উৎসর সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদের মালিকানার অপরাধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৬(২) ও ২৭(১) ধারাসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় মামলা করা হয়।