অবৈধদের দাপটে অসহায় বৈধ আইএসপিরা: সেবার নামে জিম্মি
ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে পাড়া-মহল্লায় চলছে পেশিশক্তির প্রদর্শন :: যে এলাকায় যার আধিপত্য তার
কাছ থেকে সেবা নিতে বাধ্য গ্রাহকরা
চতুর্থ শিল্প-বিপ্লবের এই যুগে প্রতিদিনই উন্নতি ঘটছে তথ্য-প্রযুক্তির। যুক্ত হচ্ছে নিত্য-নতুন উদ্ভাবন। এতে সহজ করে তুলছে মানুষের জীবন-যাত্রা। দরজায় কড়া নাড়ছে ৫জি’র সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), স্মার্ট হোম সল্যুশন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স (এআই), ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (ভিআর), রোবোটিকস, বিগ ডেটার মতো প্রযুক্তি। বাংলাদেশও ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের ঘোষণা দিয়েছে। যার প্রধান হাতিয়ার বলা হচ্ছে ডিজিটাল সংযোগ বা ডাটার মহাসড়ক এবং মুখ্য ভ‚মিকায় থাকবে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। অথচ দেশে সেই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিসে এখনো হ-য-ব-র-ল অবস্থা। লাইসেন্স নিয়ে সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের চাইতে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। দিনের পর দিন কেবল পেশিশক্তির বলে গ্রাহকে জিম্মি করে অবৈধ ব্যবসা চালালেও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় নীরব টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা-বিটিআরসি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও। একেকটি এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ইচ্ছেমত যাচ্ছেতাই গ্রাহক সেবা দিচ্ছে এসব অবৈধ ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে ধীরগতির ইন্টারনেট সেবা, টাকায় কেনা গতির চেয়ে কম দিয়ে গ্রাহক বঞ্চিত করা, এক সংযোগের ডাটা দিয়ে একাধিক সেবা প্রদান, নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি আদায়, এলাকা কেন্দ্রীক একক আধিপত্য রেখে গ্রাহক জিম্মি করার মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ।
বরাবরের মতো বিটিআরসি বলছে, লাইসেন্স ছাড়া কেউ আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) ব্যবসা করতে পারবে না। তারপরও অনেকে করে, আমরা যখন জানতে পারি বা কেউ অভিযোগ করে তখন তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তাদের জরিমানা ও মামলা করা হয়। এছাড়া যারা এসব অবৈধ আইএসপির কাকে ব্যান্ডউইথ বিক্রি করে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে এবং আইএসপিএবি’র সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন মহল্লায় বৈধ আইএসপি’র পাশাপাশি একাধিক অবৈধ আইএসপি সেবা দিচ্ছে। এর মধ্যে যাদের পেশিশক্তি বেশি তারা অন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় ওই আইএসপি’র বাইরে কারো কাছ থেকে সেবা নেয়ার কোন বিকল্প থাকে না। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সেসব আইএসপি গ্রাহককে জিম্মি করে ইচ্ছেমত সেবা দেয়। কোন গ্রাহকের সেবা পছন্দ না হলে বিকল্প না থাকায় তাদের কিছুই করার থাকে না।
বিষয়ে বিটিআরসির উপ-পরিচালক মো. জাকির হোসেন খাঁন বলেন, অবৈধভাবে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিটিআরসি থেকে যাদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে তারাই সেবা প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে ৪টি জোন ভাগ করে দেয়া আছে। অবৈধরা যে সেবা দিচ্ছে সে বিষয়ে তিনি বলেন, বিটিআরসির পক্ষ থেকে নিয়মিতই অভিযান চালানো হয়। সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ পেলেও অভিযান করা হয়। এরপর বিধি মোতাবেক জরিমানা, মামলাসহ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে আইনি দুর্বলতার কারণে তারা আবার একই সুযোগ নিচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে। বিটিআরসি ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-এর তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে এখন ইন্টারনেট সেবা প্রদান করছে লাইসেন্সধারী ২ হাজার ৮৯৬টি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি)। অভিযোগ রয়েছে বাজারের সক্ষমতা যাচাই না করেই একের পর এক আইএসপি লাইসেন্স প্রদান করা হচ্ছে। যা এখনো অব্যাহত। যেখানে পুরনো ও বৈধ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোই টিকে থাকার লড়াই করছে সেখানে একের পর এক লাইসেন্স প্রদান এবং অবৈধ আইএসপিদের কারণে কোণঠাসা আইএসপি ব্যবসায়ীরা। মহল্লায় মহল্লায় ক্ষমতাসীন দলের পরিচয় দিয়ে অবৈধ আইএসপি ব্যবসায়ীরা বৈধ ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় পার্টনারশিপ দাবি, মাসিক চাঁদা নির্ধারণসহ হয়রানি ও হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে আইএসপি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। সংগঠনটির সভাপতি এমদাদুল হক বলেন, লাইসেন্স যাদের আছে, বিটিআরসির নীতিমালা অনুয়ায়ী তারাই ব্যবসা করবে। নতুন যারা ব্যবসা করতে চায় তারা লাইসেন্স নিয়ে, সরকারের আইনকানুন মেনে ব্যবসায় আসতে পারে। কিন্তু পেশিশক্তি দিয়ে বা ক্ষমতা আছে, শক্তি আছে এটি দেখিয়ে আমি থাকবো, অন্য কাউকে ব্যবসা করতে দিব না, বের করে দেবো এটা যেনো না হয়।
আইএসপিএবি’র অভিযোগ অবৈধদের দাপটে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন বৈধ আইএসপি (ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান) ব্যবসায়ীরা। দেশে চারটি ক্যাটাগরিতে বৈধ আইএসপির সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৬টি। অথচ লাইসেন্সবিহীন বা অবৈধ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। অবৈধরা শুধু সংখ্যায় বেশি নয়, তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পেশিশক্তিও বেশি। ফলে বৈধ ব্যবসায়ীরা সরকারকে নিয়মিত কর দিয়েও ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন। আর অবৈধরা সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়েও রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার থেকে দু’গ্রæপের দ্ব›েদ্বর জের ধরে রাজধানীর আদাবর ও মনসুরাবাদ এলাকায় ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি সংযোগ বিচ্ছিন্ন। স্থানীয়রা বলছেন, এলাকায় ইন্টারনেট ও ক্যাবল টিভি সংযোগ দখলকে কেন্দ্র করে দু’গ্রæপের দ্ব›েদ্বর জেরে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। জানা গেছে, ওই এলাকার ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী প্রায় ১৫ হাজার। একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় সার্ভিস প্রোভাইডারকে ফোন করা হলে তারা জানায় যে একটি পক্ষ তাদের সংযোগ কেটে দিয়েছে। কখন পুনঃসংযোগ দেয়া হবে তা জানানো হয়নি।
সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য স্থানীয় যুবলীগ নেতা আরিফুল ইসলাম তুহিনকে দায়ী করেছে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)।
আইএসপিএবির সেক্রেটারি বিজয় কুমার পালের সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আরিফুল ইসলাম তুহিন একা ব্যবসা দখলের জন্য মঙ্গলবার সকালে জনসমক্ষে বায়তুল আমান হাউজিং, মনসুরাবাদ হাউজিং এবং সুনিবিড় হাউজিংয়ের ইন্টারনেট সংযোগ কেটে দিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, সংযোগ আবার চালু করতে গেলে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এর স্থায়ী সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ওই এলাকার সংযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
আইএসপিএবির সভাপতি মো. এমদাদুল হক বলেন, আমরা এর স্থায়ী সমাধান চাই। আগেও তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই কিন্তু এলাকার ব্যবসা দখল করতে চায়। কোনো মামলা করেছেন কি না, জানতে চাইলে এনামুল বলেন, তাদের ক্ষমতা অনেক। পাশাপাশি পুলিশের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রয়েছে। সেজন্য আমরা এখনো অপেক্ষা করছি।
আদাবর থানা যুবলীগের সাবেক আহŸায়ক আরিফুল ইসলাম তুহিন বলেন, কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে আমি জানি না। আমি ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নই। আমি ক্যাবল টিভির ব্যবসা করি। আমার ক্যাবল লাইনও কেটে দেওয়া হয়েছে এবং গ্রাহকরা অভিযোগ করছেন যে তারা বিশ্বকাপ দেখতে পাচ্ছেন না।
আশুলিয়ার একজন ব্যবসায়ী জানান, আশুলিয়ায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের ছেলে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা করে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার সব মালামাল নিয়ে চলে গেছে। তিনি স্থানীয় থানা এবং বিটিআরসিতে আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু প্রতিকার পাননি। অপর একজন ব্যবসায়ী বলেন, তিনি থানা পর্যায়ে লাইসেন্স নিয়েছেন। তার থানা এলাকা এখন ভেঙ্গে দু’টি থানা হয়ে গেছে। ফলে তার বিনিয়োগের অর্ধেকই এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
এর আগে কেরানীগঞ্জের ৭টি লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে ব্যবসায় অবৈধভাবে পার্টনারশিপ দাবি, মাসিক চাঁদা নির্ধারণসহ হয়রানি ও হুমকির অভিযোগ করে। এ থেকে মুক্তি পেতে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি ও ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-এর নিকট লিখিত আবেদন করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
অভিযোগে বলা হয়, তারা দীর্ঘদিন ধরে কেরানীগঞ্জ এলাকায় বৈধভাবে ইন্টারনেট ব্যবসা করলেও কিছু অবৈধ এবং লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়। যারা স্থানীয় প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। তারা বৈধ লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বন্ধ করে দিতে এবং ইন্টারনেট বক্স খুলে নিতে বলে। তা না হলে পরিণাম ভালো হবে না বলে হুমকি দেয়। নানারকম ভয়-ভীতি প্রদর্শনের কারণে এই প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী শেখ মশিউর রহমান মানিক ওই এলাকা ছাড়াও হয়েছেন।
আইএসপিএবি’র মহাসচিব নাজমুল করিম ভুঁইয়া জানান, চার ক্যাটাগরিতে বৈধ লাইসেন্সধারীর সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৬। কিন্তু লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। তাদের অনেকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও পেশিশক্তির অধিকারী। তাদের দাপটে বৈধ ব্যবসায়ীরা এখন অসহায়। তিনি জানান, কেবল টিভির সংযোগের ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরাই মূলত অবৈধভাবে ইন্টারনেট সংযোগ দিচ্ছে।
টিআরএনবি’র একটি অনুষ্ঠানে বিটিআরসি’র চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বলেন, বিটিআরসি’র কাছ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত সবগুলো সেবাদতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শর্ত হচ্ছে কোয়ালিটি অব সার্ভিস নিশ্চিত করা। যদি কোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেটা না করে তাহলে আইন ও বিধি অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়। স্মার্ট কানেকটভিটির জন্য কোয়লিটি অব সার্ভিস সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, অবৈধভাবে যারা ইন্টারনেট সেবা দেয়ার ব্যবসা করছে তারা কিন্তু ব্যান্ডউইথ পাচ্ছে জাতীয়ভাবে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোন বৈধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেই। কোন কোন বৈধ লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান অবৈধ ব্যবসায়ীদের ব্যান্ডউইথ দিচ্ছে তা চিহ্নিত হওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে আইএসপিএবি নেতাদেরও দায়িত্ব আছে।