Bangladesh

অবৈধ স্থাপনা গিলে খাচ্ছে কর্ণফুলী নদী

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বাসিন্দা মো. মহসিন। পেশায় ভ্যানচালক। ১৫ বছর ধরে বসবাস করছেন কর্ণফুলী নদীর তীর দখল করে গড়ে ওঠা বস্তিতে। এক রুমের একটি ঘর মাসে আড়াই হাজার টাকায় ভাড়া থাকেন। নদীর রাজাখালী খালের মুখ অংশে আছে শতাধিক ঘর।

মো. মহসিন বলেন, এক রুমের একটি ঘর মাসে ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে থাকি। প্রতি মাসে এখানকার জমিদার ভাড়া নিতে আসেন। বস্তির ঘর আকারে ছোট হলে ২ হাজার, একটু বড় হলে আড়াই হাজার টাকা। কেবল রাজাখালী খালের মুখ অংশ নয়, কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত ব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে শুরু করে চাক্তাই খাল ও বিবি মরিয়ম খালের মুখ পর্যন্ত আছে প্রায় ৫০০ বস্তি ঘর। এসব বস্তি থেকে মাসে গড়ে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। তা ছাড়া ব্রিজের পাশেই গড়ে উঠেছে বাস-ট্রাক স্টেশন। নদী দখল করেই গড়ে উঠেছে মাছের ১০৪টি আড়ত ও দ্বিতল মসজিদ। নিয়মিত অবৈধভাবে গড়ে উঠছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা। অবৈধ বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো ক্রমশ গিলে খাচ্ছে কর্ণফুলী নদীকে। ফলে প্রতিনিয়তই দখল করা হচ্ছে কর্ণফুলী নদী। কমছে নদীর আয়তন। হচ্ছে ভরাট। হারাচ্ছে নদীর নাব্য । হুমকিতে পড়ছে নদীর মৎস্য সম্পদ। চট্টগ্রাম খাল-নদী রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান বলেন, কর্ণফুলী নদী বন্দরের প্রাণ। অথচ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা ও উদাসীনতায় নদীর দখলদাররা আরও বেশি সক্রিয়। ২০১৯ সালের চিহ্নিত ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করায় দখল আরও বাড়ছে। সম্প্রতি আগের দখলদাররাই নতুন করে আনোয়ারা বদলপুরা এলাকায় কর্ণফুলী নদী দখল করে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ফলে আমাদের আবারও উচ্চ আদালতে যেতে হয়েছে। যদি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এক টেবিলে বসে সম্মিলিতভাবে কর্ণফুলীর সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে, তাহলে দখলদাররা আর নতুন করে কর্ণফুলী দখলের সাহস করবে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই কর্ণফুলীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বিঘ্নিত হবে এবং এই চলমান নদীটি তার স্বকীয়তা হারাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কর্ণফুলী নদীকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। তাই কর্ণফুলীকে নিয়ে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কাজের মধ্যে থাকবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দখল-দূষণ বন্ধ এবং নগরের গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক বর্জ্য পড়া বন্ধ করা। তবে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কর্ণফুলীকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় হুমকিতে পড়বে বন্দর। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আবদুল মালেক বলেন, কর্ণফুলী নদী থেকে অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। গত সপ্তাহেও উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হয়। এর আগে আদালতের নির্দেশনা মতে বারিক বিল্ডিং থেকে বিআইডব্লিউ ঘাট পর্যন্ত থাকা অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এটি চলমান প্রক্রিয়া। নদীর স্বার্থে এবং অবৈধ দখলদার ঠেকাতে জেলা প্রশাসনের অভিযান নিয়মিতই অব্যাহত থাকবে।

গতকাল দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, নদী দখল করে নির্মিত হয়েছে বস্তি। তৈরি হয়েছে ছোট ছোট রুম, দেওয়া হয়েছে ভাড়া। সেখানে বসছে সবজি বাজার। নদীর তীরেই আছে শত শত ঘর ও দোকান, টং দোকান। এখানেই আছে ‘আইনগত নোটিস’ নামের পাঁচটি সাইনবোর্ড। নিয়মিতই নির্মিত হচ্ছে নতুন নতুন স্থাপনা। চলছে ভরাটের কাজও। অবস্থা দেখে মনে হবে, কর্ণফুলী নদী দেখার কেউ নেই। এটি অভিভাবকহীন নদী। নদীর বুক চিরেই গড়ে উঠেছে বিশাল আয়তনের মাছের আড়ত। নির্মিত হয়েছে সোনালি যান্ত্রিক মৎস্য শিল্প সমবায় সমিতি, ভেড়া মার্কেট শ্রমজীবী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিমিটেড, মৎস্য শ্রমিক লীগ, চট্টগ্রাম ট্রাক-বাস মালিক সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তবে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে কোনো উদ্যোগ নেই। জানা যায়, ২০১৫ সালে আদালতের নির্দেশনা মতে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে তালিকা প্রকাশ করে। তা ছাড়া জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের ২ হাজার ৪৯২টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। তবে তা এখনো প্রকাশ করেনি। নদী রক্ষা কমিশনের তালিকায় মহানগর অংশে আছে ৪৯৮টি। এর মধ্যে আছে ডকইয়ার্ড, বস্তিবাড়ি, দোকান, জেটি, বন্দর, বহুতল ভবন, তেল পরিশোধন কেন্দ্র, তেল ডিপো, সিমেন্ট কারখানা, কোল্ড স্টোরেজ। তাছাড়া কর্ণফুলী নদীসংলগ্ন সাতটি উপজেলাভিত্তিক তালিকাও প্রকাশ করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দখলদার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায়, ৯২৭ জন। এখানে তৈরি করা হয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হয়েছে গ্যারেজ, হোটেল, ইটভাটা, স-মিল ও বিভিন্ন শিল্প-কারখানা। বোয়ালখালীতে আছে ২৬৬টি স্থাপনা, রাউজানে ১৭১টি, পটিয়ায় ১১টি, কর্ণফুলীতে ১৯৭টি ও আনোয়ারায় ১৬টি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ও জেলা প্রশাসনের তালিকায় দখলদারের মধ্যে আছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, কনটেইনার ডিপো, জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, মাছের আড়ত, জেটি, বস্তি ও অন্যান্য। দুটি সমীক্ষা দলই নদীর ১০ মিটারের মধ্যে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, দখলদারদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা, নদীর তীরে সৌন্দর্যবর্ধক প্রকল্প গ্রহণ ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে নদীর তীরভূমি সংরক্ষণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

কর্ণফুলী নদীতে যত অবৈধ স্থাপনা : জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন কর্ণফুলী নদীর দুই তীরে ২ হাজার ৪৯২টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরি করে। এর মধ্যে টিনের ঘর আছে ১ হাজার ৪৫৪টি, পাকা স্থাপনা আছে ৫৭২টি, আধা পাকা স্থাপনা আছে ৭০টি, মাটির ঘর ৯৩টি, ডকইয়ার্ড ১৬টি, স-মিল ২২টি, পোলট্রি ফার্ম ও গরুর খামার ২০টি, তেলের দোকান ১১টি, জেটি ৬১টি, ইটভাটা ১২টি, কয়লার ডিপো ১টি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ১০টি, পুকুর ৪টি, পানের বরজ ১টি, শুঁটকির মাচা ৬টি, বালুর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৬টি, শিল্প-কারখানা ২০টি, সরকারি স্থাপনা ৬টি ও অন্যান্য স্থাপনা ৫৫টি।

নতুন করে হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা : আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলীর উভয় তীরে ২ হাজার ১৮৭টি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আদালত এসব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। নির্দেশনা মতে, ২০১৯ সালের ৪ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি সদরঘাট থেকে বারিক বিল্ডিং এলাকা অভিযান পরিচালনা করে ২৩০টি স্থাপনা উচ্ছেদ ও ১০ একর ভূমি উদ্ধার করা হয়। কিন্তু বাকলিয়া অংশে অভিযান পরিচালিত হয়নি। এরপর থমকে যায় উচ্ছেদ। নদীর নেভাল-২ এলাকা থেকে শাহ আমানত সেতুর মোড় পর্যন্ত অংশে প্রতিনিয়তই গড়ে উঠছে নতুন নতুন দোকান, বস্তি-ঘরসহ নানা স্থাপনা। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব স্থাপনা দেওয়া হচ্ছে ভাড়া। ফলে প্রতিনিয়তই নতুন করে হচ্ছে বেদখল-ভরাট। তবে জেলা প্রশাসন বলছে, বর্তমানের অবৈধ স্থাপনাগুলো বন্দরের অধীন।

প্লাস্টিক বর্জ্যরে ভাগাড় কর্ণফুলী নদী : চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় দৈনিক ৩ হাজার টন বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্য ২৪৯ টন-৮ দশমিক ৩ শতাংশ। যার মধ্যে ৩৫ দশমিক ৬১ শতাংশ রিসাইক্লিং যোগ্য। কিন্তু এসব প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে মধ্যে সংগ্রহ হয় ১০৯ টন এবং অসংগৃহীত থেকে যায় ১৪০ টন। এই অসংগৃহীত প্লাস্টিক-পলিথিন বর্জ্যরে অধিকাংশই খাল হয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। এ কারণেই চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা, বায়ু ও মাটি দূষণ এবং নদীতে প্লাস্টিক-পলিথিনের স্তর পড়ে যাচ্ছে। অনুকণা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ, মাছসহ বিভিন্ন প্রাণীর দেহে। ২০৫১ সালের মধ্যে নগরে প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্যরে পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ৪২৮ টনে। ‘২৪৯ টন প্লাস্টিক-পলিথিন বর্র্জ্যে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য প্রকাশ করেন চুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী পিয়াল বড়ুয়া ও আল আমিন। নগরের ১৫টি ওয়ার্ডে এই গবেষণা কাজ পরিচালিত হয়।

কমছে নদীর প্রশস্ততা : ২০১৪ সালে শাহ আমানত সেতুর নিচে কর্ণফুলী নদীর প্রবাহমান ধারায় প্রস্থ ছিল ৮৬৬ মিটার। এখন তা ভাটার সময় ৪১০ মিটার ও জোয়ারের সময় ৫১০ মিটার। রাজাখালী খালের মুখে প্রশস্ততা ৪৬১ মিটার, আগে ছিল ৮৯৪ মিটার। চাক্তাই খালের মুখে এখন প্রশস্ততা ৪৩৬ মিটার, আগে ছিল ৯৩৮ মিটার। ফিরিঙ্গি বাজার মোড়ে নদীর প্রস্থ ছিল ৯০৪ মিটার, বন্দর কর্তৃপক্ষ খননের পর সেখানে নদী আছে ৭৫০ মিটার। বাকি অংশ বন্দর কর্তৃপক্ষ গাইড ওয়াল নির্মাণ করে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। শাহ আমানত সেতুর উত্তর অংশে ৪৭৬ মিটার নদী ভরাট হয়ে গেছে। ২০১৬ সালে নদী ভরাট করে গড়ে তোলা মাছ বাজার, বরফকল, অবৈধ দখল ও ভেড়া মার্কেটের কারণে চাক্তাই খালের মোহনা এলাকায় কর্ণফুলী নদীর প্রবাহমান ধারা কমে দাঁড়ায় ৪৬১ মিটারে। কর্ণফুলী নদী অবৈধ দখলের কারণে প্রশস্ততা কমছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor