Bangladesh

অভিবাসনে রেকর্ড, রেমিট্যান্সে ধীরগতি

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশে কাজ করার উদ্দেশ্যে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা গত এক বছরে ১৩ শতাংশ বেড়েছে, যা দেশের জন্য একটি মাইলফলক। তবে সে তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েনি। পাশাপাশি ১৭৬টি দেশে কর্মী যাওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ছয়টি দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক কর্মী গেছেন।

অভিবাসনে রেকর্ড, রেমিট্যান্সে ধীরগতি

গতকাল বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে প্রকাশিত অভিবাসনবিষয়ক গবেষণা সংস্থা রামরুর বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

রামরুর বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালে মাত্র ২.৮৮ শতাংশ রেমিট্যান্সের হার বেড়েছে।

প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অভিবাসন গতির সঙ্গে রেমিট্যান্সের হার বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা আমাদের একটি গবেষণায় দেখেছি, গত বছর কাজ না পেয়ে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে ১২ শতাংশের মতো কর্মী ফেরত এসেছেন। তাহলে যে কর্মী ফেরত আসছেন বা সেখানে কোনো ধরনের কাজ পাচ্ছেন না, তিনি তো কোনো টাকা পাঠাতেও পারবেন না। ফলে যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরাই যে টাকা পাঠাতে পারছেন, এটা সত্য নয়।

এ ছাড়া কর্মীরা বৈধভাবে পাঠানোর চেয়ে হুন্ডিতে সহজে পাঠাতে পারেন। ফলে এই জায়গাগুলো বন্ধ করা না গেলে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।’

করোনার পর বেড়েছে অভিবাসন

রামরুর প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, অভিবাসনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার অন্যতম কারণ ছিল কভিড-১৯ পরবর্তী প্রভাব। কভিডকালে ২০২০ ও ২০২১ সালে যেসব অভিবাসী বিদেশ যেতে পারেননি, তাঁরা ২০২২ ও ২০২৩ সালে অভিবাসন করেছেন।

এ ছাড়া কভিডের সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অভিবাসী গ্রহণকারী দেশে জনবল নেওয়া বন্ধ ছিল। কভিড-পরবর্তী সময় এসব চাকরির বাজারও উন্মুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি সব ধরনের সৌদি প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ অভিবাসন বেড়েছে। ২০২২ সাল থেকে শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ থেকেই অভিবাসনসংখ্যা বাড়ছে। উল্লিখিত বছরে নেপালে প্রবাসী কর্মী বাড়ার এই ঊর্ধ্বগতি ছিল ৩০০ গুণ বেশি।

নারী অভিবাসন কমেছে ২৭.৪৫%

বিগত এক বছরে কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়া নারী কর্মীর হার কমেছে ২৭.৪৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৭৬ হাজার ৫১৯ জন নারী কর্মী বিদেশ গেছেন, যেখানে ২০২২ সালে বিদেশ যাওয়া নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৬৬। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নারী অভিবাসনের হার কমেছে ৩.৪৪ শতাংশ।

১৭৬ দেশের ছয়টিতে যাচ্ছেন কর্মী

বাংলাদেশ থেকে ১৭৬টি দেশে কর্মী যাওয়ার কথা। কিন্তু রামরুর প্রতিবেদন বলছে, মাত্র ছয়টি দেশে কর্মী গমন করছেন। এই ছয়টি দেশের মধ্যে ২০২৩ সালে সৌদি আরবে ৩৮.১২ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৬.৯৪ শতাংশ, ওমানে ৯.৮০ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭.৫৪ শতাংশ, কাতারে ৪.৩০ শতাংশ ও সিঙ্গাপুরে ৪.০৮ শতাংশ পুরুষ কর্মী গেছেন। বাকি ১৭০টি দেশে নামমাত্র কর্মী যাচ্ছেন।

অভিবাসীদের ৫০% স্বল্প দক্ষ বেড়েছে দক্ষ শ্রমিক

রামরুর গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৩ সালে বিদেশ যাওয়া কর্মীদের মধ্যে ৫০ শতাংশই স্বল্প দক্ষ কর্মী। আগের বছরের (২০২২ সাল) তুলনায় এমন কর্মী কমে যাওয়ার হার ২৩ শতাংশ। একই সঙ্গে ২০২১ সালের তুলনায় স্বল্প দক্ষ কর্মী কমে যাওয়ার হার ২৫.১৭ শতাংশ। অর্থাৎ ধীরে ধীরে স্বল্প দক্ষ কর্মী কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে তুলনামূলক দক্ষ কর্মীর হার। আলোচ্য বছরে মোট অভিবাসীর ৪.১৪ শতাংশ ছিলেন পেশাজীবী কর্মী, ২৪.৭৭ শতাংশ দক্ষ কর্মী ও ২১.০১ শতাংশ আধাদক্ষ কর্মী। আগের বছরের তুলনায় পেশাজীবী কর্মীদের অভিবাসন হার বেড়েছে ৩.৮ শতাংশ, দক্ষ কর্মীর ২.০৪ শতাংশ এবং আধাদক্ষ কর্মীর হার বেড়েছে ১৭.৩৬ শতাংশ।

৩ থেকে ৬ মাসে ১২% কর্মী ফেরত

রামরুর গবেষণা বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কাজ না পেয়ে তিন থেকে ছয় মাসে ১২ শতাংশ কর্মী ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩৮ শতাংশ, জর্দান থেকে ২২ শতাংশ, ওমান থেকে ১৭ শতাংশ ও সৌদি আরব থেকে ১৩ শতাংশ কর্মী ফেরত এসেছেন।

রামরুর চেয়ারপারসন তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বিএমইটির পরিসংখ্যানে বলা হয়, ১৯৭৬ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অভিবাসনের উদ্দেশ্যে গেছেন এক কোটি ৬০ লাখ ৭৫ হাজার ৪৮৭ জন। তবে কাজ শেষে এবং কাজ না পেয়ে কতজন অভিবাসী দেশে ফেরত এসেছেন, বিএমইটি সেই তথ্য সংরক্ষণ করে না। কিন্তু এই তথ্য সংরক্ষণ করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়।

২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসনে ১০টি উল্লেখযোগ্য উৎস রয়েছে। এগুলো হলো : কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, নরসিংদী ও ঢাকা। তবে বিগত বছরগুলোর মতো ২০২৩ সালেও কুমিল্লা থেকে সর্বোচ্চ অভিবাসী গেছেন। আলোচ্য বছরে এক লাখ আট হাজার ৮৭০ জন বা ৮.৩৩ শতাংশ অভিবাসী কুমিল্লা থেকে গেছেন। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ৪.৯৬ শতাংশ বা ৬৪ হাজার ৮০৭ জন এবং চট্টগ্রাম থেকে ৪.৯১ শতাংশ বা ৬৪ হাজার ২০২ জন কর্মী অভিভাসন করেছেন। বাকি সাতটি উৎস থেকে অভিবাসীর সংখ্যা ও হার প্রায় এক।

প্রতিবেদন প্রকাশের সময় রামরুর পক্ষ থেকে সাতটি সুপারিশ হাজির করে ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ২০২৫ থেকে ২০৩৫ সাল পর্যন্ত অভিবাসন দশক ঘোষণা করতে হবে। শ্রম অভিবাসন ও ডায়াস্পোরার জন্য দুটি দিবস পালন না করে ১৮ ডিসেম্বর অভিবাসী দিবস পালন করা হোক। রাজনৈতিক ইশতেহারে অভিবাসীদের জন্য দেওয়া অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা হোক। অনলাইন অভিযোগের ব্যবস্থা চালু করা হোক। সর্বশেষ রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলোর প্রতি অভিবাসীদের আস্থা ফেরাতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা বলেন, ‘জাপান-দক্ষিণ কোরিয়ার অভিবাসন হচ্ছে মানসম্মত অভিবাসন। এই অভিবাসন আমাদের আরো বাড়াতে হবে। কারণ এই দেশগুলোতে যেমন দক্ষতা নিয়ে যেতে হয়, তেমনি আয়ও বাড়ে। অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অভিবাসন তৈরি করা প্রয়োজন। এ জন্য সরকারের উচিত প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো কর্মীকেই বিদেশে না পাঠানো। তাহলে মানসম্মত একটি অভিবাসন পদ্ধতি আমরা তৈরি করতে পারব।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button