Trending

অমীমাংসিত ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এবং বাকু জলবায়ু সম্মেলন

আজারবাইজানের গোবুস্তানে প্রি-হিস্টোরিক রক কার্ভিং আছে। রাজধানী বাকু থেকে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘গোবুস্তান স্টেট হিস্টোরিকাল অ্যান্ড কালচারাল রিজার্ভ’ এলাকায় প্রস্তরযুগের প্রাচীন মানুষদের পাথুরে গুহায় খোদাই চিত্র দেখে শরীরে এক বিস্ময়কর শিহরণ তৈরি হলো। বাকু জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহের পর ছুটির দিনে আমাদের পূর্বজনদের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে গিয়েছিলাম।

অ্যান্টিলোপ ও বুনো ষাঁড় শিকার থেকে শুরু করে নৌকা যাতায়াত কিংবা নাচের চিত্র—কত কী এঁকে রেখে গেছেন আমাদের পূর্বজনেরা। চলে আসার সময় এক মায়াময় টানে কেন যেন চোখ ভিজে গেল। এই প্রাচীন মানুষেরা যদি জানতেন তাদের রেখে যাওয়া পৃথিবীকে আমরা আজ কী বানিয়েছি। নিয়ানডার্থাল, ইরেকটাস, ডেনিসোভান কিংবা ফ্লোরিয়েনসিস মানুষের রেখে যাওয়া পৃথিবী আজ মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর। আমরা, এই হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষেরা, আমাদের লোভ আর মুনাফার বাহাদুরিতে প্রাচীন মানুষদের রেখে যাওয়া পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত করে রেখেছি। আর এই রুগ্ন-জীর্ণ রক্তাক্ত পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হয়েছে বাকু জলবায়ু সম্মেলনে। এটি ২৯তম কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ)।

এর আগে আরও ২৮টি সম্মেলনে বিশ্বনেতৃত্ব পৃথিবী সুরক্ষায় বহু অঙ্গীকার করলেও বাস্তবায়নে তৎপর হননি। বিশ্বনেতাদের মিথ্যা আশ্বাস আর অঙ্গীকারভঙ্গের কারণে একটি জীবন্ত গ্রহের মৃত্যু ঘটতে পারে না? প্রাচীন মানুষেরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারি কিংবা খাদ্য-সংকটের কারণে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন। আর আমরা, এই স্যাপিয়েন্স মানুষেরা শেষ হতে চলেছি আমাদের প্রশ্নহীন কার্বন নিঃসরণের কারণে। গোবুস্তানে পাথর খোদাই করে তৈরি কিছু গর্তপাত্র আছে। এখানে কী রাখতেন পাথরযুগের মানুষেরা? শিকারের মাংস, ফলমূল, ভেষজ না কোনো বীজদানা? ভাত রান্নার চল তখনো শুরু হয়নি মানবসভ্যতায়। ধানই মানুষ আবিষ্কার করেনি সেইসময়। সভ্যতার পরিক্রমায় ধান হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের চতুর্থ আবিষ্কৃত উদ্ভিদ। কালের প্রবাহে লাখো বুনো ধানকে মানুষ জমিনবন্দি করেছিল। কিন্তু সেসব ধানের সঙ্গে ‘সবুজ-বিপ্লব’ প্রকল্প বেঈমানি করেছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে করপোরেট কোম্পানির মুনাফার ময়দান বানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ধানসহ শস্যফসলের জাতবৈচিত্র্যকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আজ জলবায়ু-বিপর্যস্ত মনোপলি কৃষি মুখ থুবড়ে পড়ছে। খাদ্য উৎপাদন-ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সবই ক্ষতিগ্রস্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় অভিযোজন এবং ক্ষয়ক্ষতি পূরণের আলাপ জোরালো হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যাডাপটেশন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের (এলঅ্যান্ডডি) দাবি নিয়ে গ্লোবাল সাউথ সোচ্চার। কিন্তু এলঅ্যান্ডডি প্রশ্নে এখনো মূল দেনদরবারগুলো কেবলমাত্র ‘ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি’ নিয়ে, নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি নিয়ে স্পষ্ট-জোরালো কোনো অবস্থান এখনো জলবায়ু ডিসকোর্সে তৈরি হয়নি। বাকুর গোবুস্তান থেকে ফেরার পথে চারধারে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের টিকে থাকার স্টোন স্মৃতিচিহ্নগুলো সরব হয়ে রইল। কোনো বাজারমূল্য দিয়ে কি এসব স্মৃতিচিহ্নের দরদাম করা সম্ভব? আবার যদি অগ্ন্যুৎপাত কিংবা আরও কোনো জটিল জলবায়ু সংকটে এসব স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যায়, তবে আমরা যা হারাব তাই চলমান জলবায়ুতর্কের ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’।

চলতি আলাপখানি ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজের’ বৈশ্বিক স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা দাবি করে। বাকু জলবায়ু সম্মেলনকে বলা হচ্ছে ‘ফিনান্স কপ’। যদিও অ্যাডাপটেশন এবং এলঅ্যান্ডডি ইস্যুকে অগ্রাধিকারে না রেখে বাকু সম্মেলন ‘কার্বন-ক্রেডিট’ কিংবা ‘ফলস সলিউশনকে’ প্রমোট করতে মরিয়া। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে চলা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবর্ষণ, শৈত্যপ্রবাহ, পাহাড়ি ঢল কিংবা বন্যার কারণে কেবল ইকোনমিক নয়; নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের কারণে কেবল অবকাঠামো বা ধনসম্পদ নয়; হারিয়ে যায় বহু লোকায়ত জ্ঞান, গান, বহু রীতি, কৃত্য, বিশ্বাস ও প্রথা কিংবা বহু বিরল প্রাণসম্পদ। মানুষ কি নন-ইকোনমিক ইনটেনজিবল এমন জ্ঞানসম্পদ ছাড়া বাঁচতে পারে? তাহলে জলবায়ু -দেনদরবারের ময়দানে এই নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডিকে গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণ স্বীকৃতিসহ যুক্ত করা জরুরি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button