Trending

অমীমাংসিত ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ এবং বাকু জলবায়ু সম্মেলন

আজারবাইজানের গোবুস্তানে প্রি-হিস্টোরিক রক কার্ভিং আছে। রাজধানী বাকু থেকে প্রায় ৬৪ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘গোবুস্তান স্টেট হিস্টোরিকাল অ্যান্ড কালচারাল রিজার্ভ’ এলাকায় প্রস্তরযুগের প্রাচীন মানুষদের পাথুরে গুহায় খোদাই চিত্র দেখে শরীরে এক বিস্ময়কর শিহরণ তৈরি হলো। বাকু জলবায়ু সম্মেলনের প্রথম সপ্তাহের পর ছুটির দিনে আমাদের পূর্বজনদের স্মৃতিচিহ্ন দেখতে গিয়েছিলাম।

অ্যান্টিলোপ ও বুনো ষাঁড় শিকার থেকে শুরু করে নৌকা যাতায়াত কিংবা নাচের চিত্র—কত কী এঁকে রেখে গেছেন আমাদের পূর্বজনেরা। চলে আসার সময় এক মায়াময় টানে কেন যেন চোখ ভিজে গেল। এই প্রাচীন মানুষেরা যদি জানতেন তাদের রেখে যাওয়া পৃথিবীকে আমরা আজ কী বানিয়েছি। নিয়ানডার্থাল, ইরেকটাস, ডেনিসোভান কিংবা ফ্লোরিয়েনসিস মানুষের রেখে যাওয়া পৃথিবী আজ মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর। আমরা, এই হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষেরা, আমাদের লোভ আর মুনাফার বাহাদুরিতে প্রাচীন মানুষদের রেখে যাওয়া পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত করে রেখেছি। আর এই রুগ্ন-জীর্ণ রক্তাক্ত পৃথিবীকে বাঁচাতে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ একত্র হয়েছে বাকু জলবায়ু সম্মেলনে। এটি ২৯তম কনফারেন্স অব পার্টিস (কপ)।

এর আগে আরও ২৮টি সম্মেলনে বিশ্বনেতৃত্ব পৃথিবী সুরক্ষায় বহু অঙ্গীকার করলেও বাস্তবায়নে তৎপর হননি। বিশ্বনেতাদের মিথ্যা আশ্বাস আর অঙ্গীকারভঙ্গের কারণে একটি জীবন্ত গ্রহের মৃত্যু ঘটতে পারে না? প্রাচীন মানুষেরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মহামারি কিংবা খাদ্য-সংকটের কারণে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন। আর আমরা, এই স্যাপিয়েন্স মানুষেরা শেষ হতে চলেছি আমাদের প্রশ্নহীন কার্বন নিঃসরণের কারণে। গোবুস্তানে পাথর খোদাই করে তৈরি কিছু গর্তপাত্র আছে। এখানে কী রাখতেন পাথরযুগের মানুষেরা? শিকারের মাংস, ফলমূল, ভেষজ না কোনো বীজদানা? ভাত রান্নার চল তখনো শুরু হয়নি মানবসভ্যতায়। ধানই মানুষ আবিষ্কার করেনি সেইসময়। সভ্যতার পরিক্রমায় ধান হোমো স্যাপিয়েন্স মানুষের চতুর্থ আবিষ্কৃত উদ্ভিদ। কালের প্রবাহে লাখো বুনো ধানকে মানুষ জমিনবন্দি করেছিল। কিন্তু সেসব ধানের সঙ্গে ‘সবুজ-বিপ্লব’ প্রকল্প বেঈমানি করেছে। কৃষি ও খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে করপোরেট কোম্পানির মুনাফার ময়দান বানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী ধানসহ শস্যফসলের জাতবৈচিত্র্যকে নিঃশেষ করে দিয়েছে। আজ জলবায়ু-বিপর্যস্ত মনোপলি কৃষি মুখ থুবড়ে পড়ছে। খাদ্য উৎপাদন-ব্যবস্থা, জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি সবই ক্ষতিগ্রস্ত।

জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় অভিযোজন এবং ক্ষয়ক্ষতি পূরণের আলাপ জোরালো হচ্ছে। বিশেষ করে অ্যাডাপটেশন ও লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের (এলঅ্যান্ডডি) দাবি নিয়ে গ্লোবাল সাউথ সোচ্চার। কিন্তু এলঅ্যান্ডডি প্রশ্নে এখনো মূল দেনদরবারগুলো কেবলমাত্র ‘ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি’ নিয়ে, নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি নিয়ে স্পষ্ট-জোরালো কোনো অবস্থান এখনো জলবায়ু ডিসকোর্সে তৈরি হয়নি। বাকুর গোবুস্তান থেকে ফেরার পথে চারধারে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের টিকে থাকার স্টোন স্মৃতিচিহ্নগুলো সরব হয়ে রইল। কোনো বাজারমূল্য দিয়ে কি এসব স্মৃতিচিহ্নের দরদাম করা সম্ভব? আবার যদি অগ্ন্যুৎপাত কিংবা আরও কোনো জটিল জলবায়ু সংকটে এসব স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যায়, তবে আমরা যা হারাব তাই চলমান জলবায়ুতর্কের ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’।

চলতি আলাপখানি ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজের’ বৈশ্বিক স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা দাবি করে। বাকু জলবায়ু সম্মেলনকে বলা হচ্ছে ‘ফিনান্স কপ’। যদিও অ্যাডাপটেশন এবং এলঅ্যান্ডডি ইস্যুকে অগ্রাধিকারে না রেখে বাকু সম্মেলন ‘কার্বন-ক্রেডিট’ কিংবা ‘ফলস সলিউশনকে’ প্রমোট করতে মরিয়া। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে চলা ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়, খরা, অনাবৃষ্টি, অতিবর্ষণ, শৈত্যপ্রবাহ, পাহাড়ি ঢল কিংবা বন্যার কারণে কেবল ইকোনমিক নয়; নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের কারণে কেবল অবকাঠামো বা ধনসম্পদ নয়; হারিয়ে যায় বহু লোকায়ত জ্ঞান, গান, বহু রীতি, কৃত্য, বিশ্বাস ও প্রথা কিংবা বহু বিরল প্রাণসম্পদ। মানুষ কি নন-ইকোনমিক ইনটেনজিবল এমন জ্ঞানসম্পদ ছাড়া বাঁচতে পারে? তাহলে জলবায়ু -দেনদরবারের ময়দানে এই নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডিকে গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণ স্বীকৃতিসহ যুক্ত করা জরুরি।

বিশ্ব জলবায়ু দরবারে ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’

ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ‘লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ ইস্যু বিশ্ব জলবায়ু আলাপে জোরালোভাবে যুক্ত হয়। প্রথমদিকে ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডিই আলাপের অংশ ছিল। পরবর্তীতে আদিবাসী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর (আইপিএলসি) মাধ্যমে জলবায়ু ন্যায্যতা প্রশ্নে ‘নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির’ প্রশ্ন ক্লাইমেট ডিসকোর্সে এক ক্ষীণ এবং অবহেলিত কণ্ঠস্বর হিসেবে যুক্ত হয়েছে। ইউএনএফসিসিসির ‘নন-ইকোনমিক লসেস ইন দ্য কনটেক্সট অব দ্য ওয়ার্ক প্রোগ্রাম অন লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ প্রতিবেদনে ‘নন-ইকোনমিক’ বিষয় বলতে এমন বিষয়কে বোঝানো হয়েছে, যা সচরাচর বাজারে বিক্রি হয় না। বাজারমূল্য না থাকায় নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডিকে হিসাব করা খুব চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু মানবসভ্যতা এই নন-ইকোনমিক বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্পেনের মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপক্ষের সম্মেলনে গৃহীত রিপোর্টে ‘নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি’ নিরূপণে কিছু মেজর খাতকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর এলঅ্যান্ডডি নিরূপণে গঠিত ‘সান্টিয়াগো নেটওয়ার্ক’ বিভিন্ন সংগঠন, নেটওয়ার্ক এবং বিশেষজ্ঞদের টেকনিক্যাল সহযোগিতার জন্য কাজ শুরু করে। আইপিপির ষষ্ঠ অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে জলবায়ু হ্যাজার্ডের কারণে সংগঠিত নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির কিছু উদাহরণ যুক্ত হয়েছে। ইউএনএফসিসিসির (২০১৩) প্রতিবেদনে লস অব লাইফ, হেলথ, হিউম্যান মবিলিটি, লস অব টেরিটরি, কালচারাল হেরিটেজ, ইনডাইজেনাস লোকাল নলেজ অ্যান্ড  সোশ্যাল ক্যাপাসিটি, বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোনমিক সার্ভিস নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির এই ধরনগুলো উল্লেখ করা হয়েছে।

নন-ইকোনমিক এলএন্ডডির কোনো বিশ্বজনীন একক সংজ্ঞা নেই। জনপদ, ইকোসিস্টেম, জনগোষ্ঠী, শ্রেণি, বর্গ, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকবৈচিত্র্য, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহাসিক দার্শনিক ভিত্তি, জীবনযাপন ও পেশার ধরন অনুযায়ী এর ধরন ও পরিসর ভিন্ন ভিন্ন। বাকু জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দেওয়া বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষের কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদের নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির ধরন ও বিষয়গুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের জলবায়ুজনিত কারণে ঘটে চলা নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজের উদাহরণগুলো যুক্ত করে লেখাটি দাঁড় করানো হয়েছে।

হারানো বৃষ্টি, হারানো রিচুয়াল

ব্রাজিল থেকে বাকু সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন আমাজন বনের হুনি কুই আদিবাসী নেতা নিনাওয়া ইনু হুনি কুই। ব্রাজিল ও পেরু অংশে বসবাসকারী এই আদিবাসীরা বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পর মানুষ বনের গাছ হয়ে জন্ম নেয়। আর তাই বনের প্রতিটি লতাগুল্ম হুনিকুনিদের কাছে পবিত্র। মুকাইয়া বা শামান বা কবিরাজরা গভীর বন থেকে ফুল, পাতা, শেকড় সংগ্রহ করেন, যা ভেষজ চিকিৎসাসহ বিভিন্ন রিচুয়ালে লাগে। কিন্তু অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় আগের মতো বহু গাছ এখন আমাজন বনে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আয়াউহাসকা কিংবা পুক্সকু পুসি নামের পবিত্র গাছগুলো ক্রমশ বিরল হয়ে পড়ছে। যে কারণে দেবতা হাটজি কুজপার রিচুয়ালে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নিনাওয়ার বিমর্ষ স্মৃতি আমাকে বাংলাদেশের রেমা-কালেঙ্গা বনের আদিবাসী ত্রিপুরা গ্রামে টেনে নিল।

ত্রিপুরারা বিশ্বাস করেন, কুথুই রুগণি খ্লুম গাছটি মৃত মানুষের আত্মাকে স্বর্গের রাস্তা চিনিয়ে দেয়। অচাই বা পুরোহিত শচী কুমার দেববর্মা জানিয়েছিলেন, অনাবৃষ্টির কারণে এমন বহু লতাগুল্ম এখন আগের মতো পাওয়া যায় না। বাঙালি হিন্দুদের শারদীয় দুর্গা পূজায় ১০৮টি পদ্মফুল লাগে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের প্রতিবছর পদ্মফুল ফোটার মৌসুম ভাদ্র-আশ্বিনে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) বাংলাদেশে অকালে অতিবর্ষণ হয়েছে। বিল-জলাভূমির পদ্মফুল নষ্ট হয়ে গেছে। নিয়ম রক্ষা করতে কিছু পূজায় চড়া দামে কিছু পদ্মফুল জোগাড় করলেও ১০৮টি পদ্মফুল কম পূজাতেই ব্যবহৃত হয়েছে।

নতুন রোগ, নতুন আশঙ্কা

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ, লাইভস্টক, ফসলাদির নানা নতুন রোগ ও সংক্রমণ বাড়ছে। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, কলেরা, ম্যালেরিয়া বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে জলবায়ুগত পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। নতুন রোগ, নতুন ভোগান্তি ও আশঙ্কা তৈরি করে। নিগারি গ্রাম থেকে আসা আভম্ভ সামবুরু আদিবাসীকর্মী ক্যারোলিন নিকো লিমাচাকোতি জানান, অনাবৃষ্টি ও দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে উটের নাদোপাপিতা নামের অসুখ বাড়ছে। বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চল থেকে আসা যুব জলবায়ুকর্মী শাহীন আলম জানান, লবণাক্ততার কারণে তাদের উপকূলের গ্রামগুলোতে নারীদের নানা ধরনের জটিল রিপ্রোডাকটিভ রোগ বাড়ছে। কিশোরী মেয়েদের ঋতুস্রাবে সমস্যা হচ্ছে, বহু নারীর অপারেশন করে জরায়ু কেটে ফেলার ঘটনা ঘটছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত ও উষ্ণতা বাড়ার কারণে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের আদিবাসী খাসিদের পানজুমগুলো ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ‘উৎরাম’ নামের এক রোগের সংক্রমণ বাড়ছে।

জেনেটিক রিসোর্স এবং বায়োডাইভারসিটি

বাংলাদেশে চলতি বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ফেনী ও শেরপুর অঞ্চলের বন্যা বহু আলোচনা ও তর্কের জন্ম দেয়। শেরপুরের বন্যায় তুলশীমালাসহ আমন মৌসুমের সব ধানের জমি তলিয়ে যায়। ধানটি বাংলাদেশের একটি জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিক্যাশন। উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের কার্বিআলং থেকে বাকু সম্মেলনে যোগ দেওয়া ফোংলাংসো গ্রামের আদিবাসী জলবায়ুকর্মী রুকাসেন বিপি জানান, কার্বি আদিবাসীদের প্রাচীন শস্য ফসলগুলো দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টির কারণে লোরূপ ও লোচিন নামের দুটি বুনো কলার জাত এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন।

বলিভিয়া থেকে এবারও অংশ নিয়েছেন খাদ্য অধিকারকর্মী আইরশ রইজ কন্ডরি। গতবার অনাবৃষ্টি আর খরার কারণে তাদের হারানো বুনো আলুর কথা লিখেছিলাম দুবাই জলবায়ু সম্মেলন থেকে। এবারও একই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কার্বন-কপি শোনালেন। বাংলাদেশের বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ি গ্রাম থেকে আসা আদিবাসী চাক যুব জলবায়ুকর্মী উ খিং নু চাকের কাছ থেকে জানা যায়, তার দিদিমা জানিংমে চাক জানিয়েছেন, পাহাড়ি গ্রামে আগে নানা রঙের মোক্কা (ভুট্টা) ছিল। কিন্তু এখন কমে যাচ্ছে। অনাবৃষ্টি, পানি সংকট ও উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বহু পাহাড়ি ফসল হারিয়ে যাচ্ছে। ফিলিপাইন থেকে আসা কৃষক-বিজ্ঞানী লিওডিগারিও ভেলাও এবং রোয়েনা বুয়েনা জানালেন, বহু আদি ধানের জাত হারিয়ে গেছে এবং তারা চেষ্টা করছেন সেসব জাত সংরক্ষণ করতে।

অচেনা টেরিটরি, নতুন সংঘাত

ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা, উষ্ণতার কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের উদ্বাস্তু ও স্থানান্তর হতে হচ্ছে। বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও নেত্রকোণার কলমাকান্দা গেলে দেখা যায়, প্রতি হেমন্তের সন্ধ্যায় গ্রামীণ জেন-জিরা কাজের খোঁজে চলে চলে যাচ্ছে। কেবল দেশের ভেতর নয়, বহুদূরের দেশেও এই অভিবাসন ঘটছে। কিন্তু এটি কোনোভাবেই মানব ইতিহাসের সাংস্কৃতিক স্থানান্তর প্রক্রিয়া নয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চাষাবাদ ও কাজের ক্ষেত্র হারানোর ফলে মানুষ নিজের জন্মমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়। ছাড়তে হয় গ্রামের চিরচেনা জায়গা, সমাধি ও কবরস্থান, শৈশবের খেলার মাঠ, ধর্মীয় উপাসনালয় ও চিরচেনা প্রতিবেশী আত্মীয়স্বজনদের।

ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ফিজি থেকে আসা ক্লাইমেট টকের প্রতিনিধি মাকেরেতা ওয়াকাভোনোভোনো জানান, ভয়াবহ সব টাইডাল সার্জের কারণে বহুবার তাদের বসতি পাল্টাতে হয়। বাংলাদেশের মেঘনা, যমুনা কিংবা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ভাঙনকবলিত মানুষের চেহারা যেন সামনে ভেসে উঠল। ‘জন্মমাটির টান’ বলে যে বহুল প্রচলিত সম্পর্ক আছে, তা ভেঙে যায়। নতুন বসতিতে মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়। তৈরি হয় নানা ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত।

শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ভিকালপানি ন্যাশনাল উইমেন ফেডারেশনের প্রতিনিধি চাথুরিকা সিওয়ানদি জানান, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে স্থানান্তরে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় নারী ও শিশুদের। তাদের ক্ষেত্রে ভায়োলেন্স ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে। সম্মেলনে যোগ দেওয়া বিশিষ্ট বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খান জানান, ক্লাইমেট ইনডিউজড ডিজাস্টারের কারণে বন্যপ্রাণীরা দলছুট ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জীবন বাঁচাতে পরিচিত টেরিটরি ছেড়ে অচেনা জায়গায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। এতে বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক জেনেটিক বিস্তার ও জেনেটিক সংমিশ্রণ সংকুচিত হতে পারে, যা বন্যপ্রাণীর জীবনে এক নতুন আশঙ্কা ও বিপদ তৈরি করছে। সিডর, আইলা কিংবা রিমাল ঘূর্ণিঝড়ে বাংলাদেশের সুন্দরবনের বাঘ ও হরিণদের জীবনে টেরিটরি বদলের যে করুণ অভিজ্ঞতা ঘটেছে, তা কি বিগত ২৮টি জলবায়ু সম্মেলন শুনতে চেয়েছে?

লোকায়ত জ্ঞান, বিশ্বাস ও নতুন ‘সন্দেহ’

একক সময়ে অতিবর্ষণের ফলে সৃষ্ট ২০২২ সালে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ-সিলেটের বন্যায় প্রাণ ও সম্পদহানির পাশাপাশি হারিয়ে গিয়েছিল বহু ধামাইল গান। হাওরাঞ্চলের নারীদের একটি গানের খাতা থাকে, সেখানে তারা ধামাইল গান লিখে রাখেন। হঠাৎ বন্যায় সবকিছুর সঙ্গে তলিয়ে যায় গানের খাতাগুলোও। জলবায়ু সংকটের কারণে প্রতিদিন বিশ্বব্যাপী হারিয়ে যাচ্ছে বহু গান, ভাষা, লোকায়ত জ্ঞান ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। বান্দরবানের পাহাড়ে বেঁচে আছেন রেংমিটচা ভাষাভাষীদের মাত্র ছয়জন। পানি ও ভূমি সংকট সেখানে তাদের বেঁচে থাকাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। করোনা মহামারির প্রথম প্রবাহে ভারতের আন্দামান-নিবোবর দ্বীপের বেঁচে থাকা সর্বশেষ সারে ভাষীর মৃত্যু হলে ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটে।

যুক্তরাজ্য থেকে আসা ব্রাহমা কুমারিস সংগঠনের প্রতিনিধি মওরিন গুডম্যান জানান, ফেইথ খুবই ইনক্লুসিভ বিষয়। আমরা এই বিশ্বসংসারে সবাই একসঙ্গে বসবাস করি। এখানে একজন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্যজনও প্রভাবিত হয়। ক্লাইমেট চেঞ্জ আমাদের শরীর ও মনের ওপর প্রভাব ফেলে। অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়। ট্র্যাডিশনাল নলেজ ও স্পিরিচুয়াল ফেইথ আমাদের কমাতে পারে। কিন্তু ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে আমরা বহু মূল্যবান নলেজ ও ফেইথ হারিয়ে ফেলছি।

সম্মেলনে যোগ দেওয়া ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতুর পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি স্টেফানি স্টিফেনস গবেষণা করেছেন তাদের বুনো ইয়াম আলুর কালচারাল রিলেশন নিয়ে। আলাপকালে জানান, টাইডাল সার্জের কারণে উপকূল গ্রামগুলো তলিয়ে যাওয়ায় মানুষ প্রতিনিয়ত পাহাড়ি এলাকায় যেতে বাধ্য হয়। নতুন এলাকায় আগের ওষুধি উদ্ভিদ খুঁজে পাওয়া যায় না, হারিয়ে যায় লোকায়ত ভেষজ জ্ঞান। ইয়েরমানেং আদিবাসী জনগোষ্ঠীর এই প্রতিনিধি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি ইয়াম আলুর মতো রুট ক্রপের স্পিরিচুয়াল গার্ডিয়ান হচ্ছেন দেবতা টুপুনিস। জলোচ্ছ্বাসের কারণে বসতি হারিয়ে যখন নতুন বসতিতে পূর্ববসতির মতো ইয়ামের ফলন না পেয়ে নতুন প্রজন্মের বহুজন টুপুনিসের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা হারায়। টুপুনিস কেন আগের মতো ফলন নিশ্চিত করেন না এই প্রশ্ন করে। নারীরা বীজ ও জেনেটিক রিসোর্সের ঐতিহাসিক রক্ষক হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গ্রামীণ নারীর লোকায়ত জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। বস্ত্রবয়ন, কৃষিচর্চা, স্থানীয় অভিযোজন, গ্রামীণ স্থাপত্য, রন্ধনশিল্প, ভেষজবিদ্যা কিংবা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত বহু লোকায়ত চর্চা ও জ্ঞান জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রিটিক্যালি বিপন্ন।

নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অঙ্গীকার

নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির প্রধানতম বিষয় প্রাণহানি। সেন্দাই ফ্রেমওয়ার্কের প্রধান টার্গেট হলো জানমালের ক্ষয়ক্ষতি শূন্যে নামিয়ে আনা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং অভিযোজনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান থাকলেও নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি বিষয়ে বাংলাদেশ এখনো সক্রিয় নয়। এ বিষয়ে নীতিমালা এবং ব্যবস্থাপনাগত কাঠামো গড়ে তোলা জরুরি। বাকু সম্মেলনে বাংলাদেশ এলঅ্যান্ডডি অ্যাসেসমেন্টের জন্য একটি জাতীয় ফ্রেমওয়ার্ক উপস্থাপন করেছে। কিন্তু নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির বিষয়কে সুনির্দিষ্টভাবে কাঠামোতে যুক্ত করতে হবে। এর জন্য দেশের সর্বস্তরের সব অঞ্চলের জনসম্মতি প্রয়োজন এবং একইসঙ্গে দেশের সব ইকোসিস্টেম ও কমিউনিটির নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি বিষয়ে সমন্বিত গবেষণা ও ডক্যুমেন্টশন জরুরি।

বাংলাদেশের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এলঅ্যান্ডডিকে মানবাধিকার ইস্যু এবং জলবায়ু ন্যায্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনার প্রস্তাব করেছেন। বাকু সম্মেলনে যোগ দেওয়া ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র পানামার অ্যাঞ্জেলিকান চার্চের বিশপ জুলিও মুরে জানান, জলবায়ু পরিবর্তন ধর্মীয় জীবনকে প্রভাবিত করে এবং এই নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি মোকাবিলায় বিশ্ব ধর্মীয় নেতাদের এগিয়ে আসা জরুরি। লোকায়ত জ্ঞান এবং জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতাগুলোকে স্বীকৃতি ও সুরক্ষার মাধ্যমে এই কাজ শুরু হতে পারে।

ক্লাইমেট ফিনান্স ও তহবিলের নেগোসিয়েশনে গুরুত্ব দিয়ে নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডিকে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে যুক্ত করতে হবে। রাষ্ট্রগুলোকে এনডিসি, ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান এবং ন্যাশনাল বায়োডাইভার্সিটি স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান (এনবিএসএপি) প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাকু জলবায়ু সম্মেলন থেকে নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি বিষয়ে ন্যায্য রাজনৈতিক অঙ্গীকার কি আমরা আশা করতে পারি?

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
Toto Gacor
bacan4d
bacansport login
slot gacor
pasaran togel resmi
bacan4d
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
slotgacor
bacan4d rtp
bacan4d
bacan4d toto
Slot Casino
bacan4d toto
slot gacor
bacan4d
bacan4d
Slot Toto
bacan4d
bacan4d login
totoslotgacor
slot gacor
TOTO GACOR
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto slot
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
Slot Gacor
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot
xx1toto
bacansport
bacan4d
toto slot
situs toto
slot gacor
Toto Slot
slot maxwin
slot demo
bacan4d toto slot
bacan4d toto slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d slot
bacansports
bacansports
bacansports
bacan4d slot
bacan4d slot
bacan4d
slot gacor
pasaran togel resmi
situs toto
bacan4d login
pasaran togel
pasaran togel
situs toto
bacan4d
bacan4d gacor
bacan4d slot
bacan4d rtp
bacan4d rtp
bacan4d slot gacor
toto slot
situs toto
bacan4d
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
toto gacor Toto Gacor bacan4d slot toto casino slot slot gacor bacantoto totogacorslot Toto gacor bacan4d login slotgacor bacan4d bacan4d toto Slot Gacor toto 4d bacan4d toto slot bacan4d slot gacor