Bangladesh

‘অযোগ্যতা’র জালে বিএনপি

দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজা পাওয়া আসামি সাংবিধানিকভাবেই সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হবেন বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট। আদালতের এই পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানসহ বেশ কিছু নেতা ইতিমধ্যে আদালত কর্তৃক দন্ডিত হওয়ায় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য হয়ে গেছেন। বিএনপির দাবি, সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত এই সংখ্যা অর্ধশতাধিক। শুধু তা-ই নয়, দলটি আশঙ্কা করছে দলের আরও বেশ কিছু সিনিয়র নেতাকে আগামী নির্বাচনের আগে বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এই তালিকায় আছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা।

দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপির পাঁচ নেতার আলাদা আবেদন খারিজ করে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর সংক্ষিপ্ত এ রায় ঘোষণা করেছিল। পাঁচ বছর পর সম্প্রতি দুই বিচারপতির সই শেষে ৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় রবিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিমসহ সাজাপ্রাপ্ত কেউই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। হাইকোর্ট গতকাল প্রকাশিত রায়ে বলেছেন, সাজা কখনো স্থগিত হয় না। উপযুক্ত আদালতে সাজা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ নাই। এই রায়ের আলোকে দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তিই আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। কারণ তাদের সাজা বাতিল হয়নি। যদি হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ সংশোধন করেন বা বাতিল করেন, সেটা ভিন্ন কথা।’

দুদক আইনজীবী আরও বলেন, ‘দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্তদের বিষয়ে আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তবে সংবিধানের আলোকে ফৌজদারি মামলা যেগুলো নৈতিক স্খলনজনিত, সেগুলোতে সাজা হলে তারাও নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। কারণ দুর্নীতি একটি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ। তবে সব ফৌজদারি মামলা এর আওতাভুক্ত না-ও হতে পারে।’

বিএনপি নেতাদের দাবি, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের জনপ্রিয় ও যোগ্য নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে বিভিন্ন মামলায় সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এর সংখ্যা অর্ধশতাধিক পৌঁছেছে। মামলার গতি দেখে মনে হচ্ছে নির্বাচনের আগে এ সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যাবে।’

মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলের জনপ্রিয় ও যোগ্য নেতাদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে বর্তমান সরকারের আমলে দায়ের হওয়া মামলার রায় দ্রুত দেওয়া হতে পারে। ইতিমধ্যে আমাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কয়েকজন নেতাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। আরও অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় রায় দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করছে। আমরা যতদূর জানতে পেরেছি, সরকার ইতিমধ্যে প্রায় সাড়ে ১ হাজার ৩০০ মামলা চিহ্নিত করেছে, যে মামলাগুলো নির্বাচনের আগেই তারা শুনানি করে সাজা দিয়ে দেবে।’

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাগুলোতে যে সাজা দেওয়া হচ্ছে তার পরিসংখ্যান আমরা তৈরি করছি। আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে এ বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানানো হবে আনুষ্ঠানিকভাবে। ’

বিএনপি নেতাদের মামলাগুলো পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, ‘বিএনপির জ্যেষ্ঠ ও জনপ্রিয় নেতাদের ইতিপূর্বে দায়ের করা মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সেই প্রক্রিয়া অনেকটা এগিয়ে নিয়েছে এবং তফসিল ঘোষণার আগে তারা বাকিদের অযোগ্য ঘোষণার কাজ করছে। সরকার দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের আদালতের মাধ্যমে সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার চেষ্টা করছে।’

সংবিধান অনুযায়ী ফৌজদারি মামলায় কমপক্ষে দুই বছরের সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে এ কারণেই অংশ নিতে পারেননি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

আমানউল্লাহ আমানসহ বিএনপির পাঁচ নেতা ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মো. আব্দুল ওহাব, মো. মশিউর রহমান ও এ জেড এম জাহিদ হোসেন দুর্নীতির পৃথক মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া দন্ড ও সাজা স্থগিতের আবেদন খারিজ করে ২০১৮ সালের রায় দিয়েছিল হাইকোর্ট। ৪৪ পৃষ্ঠার ওই রায় রবিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।

এদিকে বিএনপির দপ্তর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩০ মে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা দুর্নীতির দুই মামলায় ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং আমানের স্ত্রী সাবেরা আমানের আপিল খারিজ করে বিচারিক আদালতের সাজার রায় বহাল রেখেছে হাইকোর্ট। ৯ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার ভাটারা থানায় ৮ বছর আগে দায়ের করা মামলায় বিএনপির ১৫ নেতা-কর্মীকে ৪ বছরের কারাদ- দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জসিম। দন্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান হাবিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. শাহজাহান এবং কুষ্টিয়া-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আহসান হাবিব লিংকন। অন্য দন্ডিত ব্যক্তিরা হলেন বিএনপির গ্রাম সরকারবিষয়ক সহসম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল আহমেদ, সহপ্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ শামীমুর রহমান শামীম এবং তৌহিদুল ইসলাম তুহিন, মনিরুল হক মনির, মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম, মাসুদ রানা, আব্দুর রাজ্জাক, জিয়াউল ইসলাম জুয়েল, মো. আরিফ, মোহাম্মদ নিশান মিয়া, মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান সুমন ও মোজাম্মেল হক। এ ছাড়া ১৮ অক্টোবর রাজধানীর বাড্ডা থানায় নাশকতার অভিযোগে করা মামলায় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় আরও ১১ নেতাকর্মীকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানিকে।

বিএনপি নেতারা অভিযোগ করে বলেন, ‘শুধু জাতীয় পর্যায়ের নেতাদেরই নয়, তৃণমূল পর্যায়ে, বিশেষ করে জেলা পর্যায়ের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায়ও সাজা দেওয়া শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত ২৪ সেপ্টেম্বর প্রতারণার মামলায় রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদকে তিন বছরের কারাদ- দিয়েছে রাজশাহীর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১। ২০০৭ সালের ২৯ জুলাই মাসুদ রানা নামে এক শিক্ষক মামলাটি করেছিলেন। এ ছাড়া গত ১৮ এপ্রিল দুই দশক আগে সাতক্ষীরায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় করা মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিবসহ চারজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় আদালত। বর্তমানে হাবিব কারাগারে রয়েছেন।’

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘সারা দেশের প্রতিটি জেলায় একটি-দুটি মামলায় দ্রুত সাজা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে মামলাগুলোর তারিখ দ্রুত ঘোষণা করে রায় দেওয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। ময়মনসিংহে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও আমার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তারিখ প্রতি সপ্তাহে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া ময়মনসিংহ বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি শরিফুল আলম, নেত্রকোনায় হয়রত আলী, মাহমুদুল হক রুবেল, জামালপুরে ওয়ারেস আলী মামুন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, ফরিদুল কবির তালুকদার দুলু, নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সভাপতি ডা. আনোয়ারুল হক, রফিকুল ইসলাম হিলালীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার তারিখ দ্রুত দেওয়া হচ্ছে নির্বাচনের আগে সাজা দেওয়ার জন্য।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor