অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন শুরু

রফতানি আয় বেড়ে গেছে। বিপরীতে প্রকৃত আমদানি বাড়ায় সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে। অপর দিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ায় চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
- রফতানি বাড়ায় বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে
- কমেছে চলতি ও সামগ্রিক হিসাবের ভারসাম্য
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া শুরু হওয়ায় অর্থপাচার কমে গেছে। এতে রফতানি আয় বেড়ে গেছে। বিপরীতে প্রকৃত আমদানি বাড়ায় সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি কমে গেছে। অপর দিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা চলতি হিসাবের ভারসাম্য ঋণাত্মক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। পাশাপাশি সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যও উন্নতি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নীতিনির্ধারকদের ওপর থেকে কাগুজে প্রবৃদ্ধি দেখানোর চাপ কমেছে। এতে অর্থনীতির প্রকৃত অবস্থান তুলে ধরতে পারছেন তারা। আর এরই সুফল পাওয়া যাচ্ছে অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবাহের মধ্যেও রফতানি আয় ঘুড়ে দাঁড়াচ্ছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে আওয়ামী সমর্থক এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী গোষ্ঠী অর্থপাচার করত। তারা রফতানি আয়ের বড় একটি অংশই পাচার করত। পণ্যের মূল্য কম দেখিয়ে অর্থপাচার ছিল নিয়মিত বিষয়। তদারকি সংস্থাগুলো তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারতেন না। ৫ আগস্টে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতি পণ্যের মূল্য যেখানে এক হাজার টাকা সেখানে মাত্র ১০০ টাকা দেখিয়ে রফতানি করা হয়েছে। এ হিসাবে ১০০ কোটি টাকার রফতানির মধ্যে আয় হতো মাত্র এক কোটি টাকা। ৯৯ কোটি টাকাই পাচার করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষনা সংস্থা সিপিডির হিসাবে গত দেড় দশকে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ২৮ লাখ কোটি টাকা যার বড় অংশই পাচার হয়েছে আমদানি-রফতানির মাধ্যমে। ৫ আগস্টের পর অর্থপাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রফতানি আয়ের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) সামগ্রিক রফতানি আয় হয়েছিল যেখানে দুই হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে হয়েছে তিন হাজার চার কোটি ডলার। অর্থাৎ সামগ্রিক রফতানি আয় বেড়েছে ৯ দশমিক ১ শতাংশ। আর একক খাত তৈরী পোশাকের রফতানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৬ শতাংশ।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রফতানির পাশাপাশি অর্থপাচারের আরেকটি খাত ছিল আমদানি। পণ্যের মূল্য বেশি দেখিয়ে আবার কখনো ঘোষিত পণ্য না এনে অর্থপাচার করা হতো। দেখা যেত, আন্তর্জাতিক বাজারে কোনো পণ্যের মূল্য এক কোটি টাকা, ক্ষেত্রবিশেষ তা ১০ থেকে ৫০ গুণ বাড়িয়ে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত দেখিয়ে অর্থপাচার করা হতো। ফলে আমদানির প্রবৃদ্ধি হতো ৩০ শতাংশ, ৪০ শতাংশ। কিন্তু ৫ আগস্টের পর আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচার প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আমদানিতে আর তত প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৪ শতাংশ। আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি রফতানি আয় বেড়ে যাওয়ায় পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি কমে এসেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যেখানে পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪৩৩ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে এসেছে এক হাজার ৩৭০ কোটি ডলারে। সামগ্রিক পণ্য বাণিজ্য ঘাটতি আলোচ্য সময়ে কমেছে সাড়ে ৪ শতাংশ।
এ দিকে অর্থপাচারের আরেকটি খাত ছিল হুন্ডি প্রবণতা। আগে প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের একটি বড় অংশই হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে যেত। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশীদের আয়ের একটি অংশ পাচারকারীরা সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে কিনে নিত। কিন্তু ওই অর্থ আর দেশে পাঠানো হতো না। বিপরীতে দেশে থাকা প্রবাসীদের অত্মীয়স্বজনকে সমপরিমাণ দেশীয় মুদ্রা পরিশোধ করা হতো। যেমন- মালয়েশিয়ায় কর্মরত বাংলাদেশী কোনো শ্রমিকের কাছ থেকে ওই দেশে থাকা হুন্ডিকারবারিরা মালয়েশিয়া মুদ্রা রিংগিত কিনে নিত। সমপরিমাণ অর্থ দেশে থাকা প্রবাসীর আত্মীয় পরিজনকে টাকায় পরিশোধ করা হতো। এতে প্রকৃত প্রবাসী আয় দেশে আসতে না। ৫ আগস্টের পর হুন্ডির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় বেড়ে গেছে। গত দুই মাস ধরে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার করে প্রবাসী আয় দেশে আসছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিশ্বের বিভিন্ন শ্রমবাজারে যেসংখ্যক বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন, তাদের কাছ থেকে সঠিকভাবে আর্জিত আয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে আনার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রতি মাসে প্রবাসী আয় ৪ বিলিয়ন ডলার ছেড়ে যাবে, এত কঠিন শর্তে দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রয়োজন হতো না। তবে, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা চলতি হিসাবের ঋণাত্মক ধারা উন্নতি হতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে চলতি হিসাবের ভারসাম্য ছিল ঋণাত্মক ৪০৭ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ১২৬ কোটি ডলার। চলতি হিসাবের ভারসাম্যের ঋণাত্মক ধারা কমে আসায় সামগ্রিক লেনদেনের ভারসাম্যও উন্নতি হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সামগ্রিক হিসাবের লেনদেনেরে ভারসাম্য ছিল ঋণাত্মক ৪৪৪ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে এসেছে ১১১ কোটি ডলারে।