Trending

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ পাত্তা দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক

এক লাখ কোটি টাকার কাগজশিল্প চরম সংকটে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তা না পাওয়াসহ নানান প্রতিবন্ধকতায় এই শিল্পের ১০৬টি কারখানার মধ্যে ৭০টিই এখন বন্ধ। যেগুলো চালু আছে সেখানেও গ্যাস স্বল্পতায় উৎপাদন সক্ষমতা কমেছে ৩০ শতাংশ। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে খাতটি যখন ধুঁকছে, তখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সহায়তার বিষয়টি বিবেচনার পরামর্শ দিলেও পাত্তা দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।

বরং তা উপেক্ষা করে নীরব ভূমিকা পালন করছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি। দায়সারাভাবে ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা সচল রাখতে প্রয়োজনীয় নীতিসহায়তা দেওয়ার জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই কমিটির কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকেই নীতিসহায়তার জন্য সুপারিশ করেনি কমিটি।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের দফায় দফায় চিঠি, কাগজশিল্প খাতের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, এ খাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ২৫ লাখ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এর সঙ্গে অন্তত ৩০০টি লিংকেজ শিল্পও জড়িত। এই খাতে মোটা বিনিয়োগের ফলে ৯ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে এখানে কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা ১৬ লাখ টন। ফলে উদ্বৃত্ত কাগজ বিশ্বের ৪০টি দেশে রপ্তানি হয়।

কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুৎ, কাঁচামাল, ডলার ও ঋণ সংকটে এই খাতটি এখন রুগ্ণ প্রায়। অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারিয়ে বর্তমানে চরম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় খাতটি।

কাগজশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, নব্বইয়ের দশকে বড় বড় শিল্প গ্রুপ বিনিয়োগে আসায় কাগজশিল্প স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। এই শিল্পের প্রসারের ফলে কাগজ ও এ জাতীয় পণ্য আমদানি ব্যাপক হারে কমেছে। যদিও চোরাচালান ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে শুল্ক ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে অবৈধ পথে কাগজ আমদানি এ খাতটির অগ্রগতির পথে অন্যতম বাধা। এর সঙ্গে বন্ড সুবিধায় বিনা শুল্কে আমদানি করা কাগজ খোলাবাজারে কম দামে বিক্রি করায় অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে দেশীয় কাগজশিল্প।

কাগজশিল্পকে রক্ষায় অর্থ মন্ত্রণালয় গত ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে। ওই চিঠিতে সংকটে থাকা কাগজশিল্পকে নীতিসহায়তা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এর সিনিয়র সহকারী সচিব ফারজানা জাহানের দেওয়া চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে এই শিল্পের সহায়তায় বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। এতে এ খাতের ব্যাংক ঋণের বকেয়া সুদ/মুনাফা ও আসল ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্লকড হিসাবে স্থানান্তরপূর্বক এক বছরের মরাটিয়াম সুবিধাসহ ১০ বছরে পরিশোধের সুযোগ দেওয়া, এ খাতের শিল্পঋণ গ্রহীতাদের ঋণ হিসাবের জন্য ব্লকড সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে ঋণ স্থিতির ২ শতাংশ হারে ডাউনপেমেন্ট গ্রহণ করা, ব্লক হিসাবে স্থানান্তরিত ঋণের ওপর কস্ট অব ফান্ড হারে সুদ আরোপ করা ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সার্কুলার জারির ছয় মাসের মধ্যে আবেদনকরণ ইত্যাদি সুপারিশ করা হয়।

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিয়ে উল্টো বিভিন্ন খাতের নানা সংকটে ঋণখেলাপি হওয়া প্রতিষ্ঠানের ৫০ কোটি টাকা বা তারও বড় অঙ্কের ঋণ বিবেচনা করতে একটি কমিটি করা হয়েছে বলে জানায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে, আলাদা করে নীতিসহায়তা দেওয়ার চেয়ে এই কমিটি পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটিই কার্যকর হবে।

কমিটি সূত্র জানায়, তারা বিষয়গুলো পর্যালোচনা করছে। এ পর্যন্ত শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। কিন্তু এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি যে কারা সুবিধা পাবে।

কাগজশিল্পের কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান নীতিগত বাধার কারণে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘একবার কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়ে গেলে, নীতিমালার কারণে তারা আর কাঁচামাল আমদানি করতে পারে না—এটি শিল্পোন্নয়নের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ব্যাংকে যদি কারো ৫০০ কোটি টাকার ঋণ থাকে, তাহলে তাকে সম্পূর্ণভাবে অক্ষম করে দিলে সে কিভাবে সেই ঋণ পরিশোধ করবে? কাঁচামাল না আনতে পারলে উৎপাদন থেমে যাবে, তখন সে ঋণ শোধের পথও বন্ধ হয়ে যাবে। এই বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সব খেলাপিই যে ইচ্ছাকৃত, তা নয়। অনেকেই বাস্তব পরিস্থিতিতে পড়ে খেলাপি হয়েছে। তাদের আলাদা করে বিবেচনা করা দরকার।’

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৩ ফেব্রুয়ারি একটি চিঠি দেয় কাগজশিল্প মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিবকে। ওই চিঠিতে বলা হয়, কাগজশিল্পের বকেয়া ঋণের সুদ ও আসল সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তরপূর্বক ঋণের কিস্তি দুই বছরের জন্য মরাটারিয়াম সুবিধা ও ১৫ বছরের জন্য পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়। একই সঙ্গে হ্রাসকৃত সুদে নতুন চলতি মূলধন ঋণ মঞ্জুর করার কথাও বলা হয়।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোকে বিশেষ বিবেচনায় সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়েই রয়েছে। এখনো কারো ব্যাপারেই চুড়ান্ত কোনো সুপারিশ কমিটি থেকে করা হয়নি। এরই মধ্যে কয়েকজন গ্রাহকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। প্রাথমিক মিটিংগুলো শেষ হয়েছে। একে একে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তগুলো এখন আসবে। এক হাজারেরও বেশি আবেদন পড়েছে। এগুলো সব যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা একটি কঠিন কাজ। ব্যাংক, গ্রাহক ও কমিটির মধ্যে আলোচনা করেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। কোনো কোনো পার্টির একাধিক ব্যাংকে ঋণ আছে।’ খুব সিগগিরই সিদ্ধান্ত আসবে বলেও জানান মুখপাত্র।

এ বিষয়ে পার্ল পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের পরিচালক (কমার্শিয়াল) রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা কাগজ কারখানায় গ্যাস পাচ্ছি না। এতে উৎপাদন ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। ধামরাইতে আমাদের কারখানায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের সমস্যা, কিন্তু এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। ব্যাংক ঋণের সুদহার দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় পরিচালন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এতে কারখানা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’

বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে ১০৬টি কাগজ মিলের মধ্যে গত তিন বছরে ৭০টির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস ও কাঁচামাল সংকটে বাকি ৩৬টি কারখানা চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাগজশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে।

বিপিএমএর সচিব নওশেরুল আলম বলেন, ‘দেশের কাগজ ও কাগজজাতীয় মিলগুলো মানসম্মত বিভিন্ন কাগজ উৎপাদন করছে। গ্যাস সংকট, এলসি সংকট ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কারখানায় উৎপাদন প্রায় অর্ধেক কমেছে। এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে বিক্রি কমে যাওয়া, ঋণের উচ্চ সুদহার এবং ঋণখেলাপির নতুন সংজ্ঞার কারণে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বেড়েছে উদ্যোক্তাদের। অনেকে চলতি মূলধনের জোগান দিতে না পেরে কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। করোনা মহামারির পর থেকে একের পর এক সংকটে ৭০টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।’

চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, জ্বালানিসংকট তথা গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, সংযোগ প্রদানে দীর্ঘসূত্রতা, ঘন ঘন লোডশেডিংসহ নানা সমস্যা এই খাতকে লাভজনক শিল্পে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। সম্প্রতি জ্বালানির মূল্য প্রায় ৩০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে, যা কাগজশিল্পকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টেকসই স্থানে পৌঁছতে দিচ্ছে না।

কাগজ উৎপাদনকারী শিল্পের প্রধান কাঁচামাল ওয়েস্ট পেপার, পাল্প, কেমিক্যালসের ৭০ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। বর্তমানে দেশীয় কাগজ মিলগুলো তারল্য সংকটের কারণে প্রধান কাঁচামাল পাল্প আমদানি করতে পারছে না। তাই সময়মতো জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) চাহিদামতো কাগজ সরবরাহ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ক্রান্তিকালে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সহায়তা না পেলে বিপুল সম্ভাবনাময় দেশীয় কাগজশিল্প খাতের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে এবং লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত ও হাজার হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। এই বিরূপ পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা/সুবিধা না পেলে এই শিল্প খাতের ঋণ প্রহীতারা ঋণখেলাপি হিসেবে গণ্য হবেন। ফলে সামগ্রিক ব্যবসা ও ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto