Trending

অর্ধকোটি চাঁদায় বাস চলে ঢাকায়

রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে তিন হাজার বাস চলাচল করে। এ সংখ্যা কয়েক বছর আগেও ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। বাসের পাশাপাশি প্রায় দুই হাজারের মতো চলে হিউম্যান হলার (লেগুনা)। এসব যাত্রীবাহী বাস ও লেগুনা থেকে প্রতিদিন প্রায় অর্ধ কোটি টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এ চাঁদা সাধারণত রাজনৈতিক নেতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং পরিবহন ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা অভিযোগে বলছেন, এই চাঁদাবাজির কারণে রাজধানীর সড়কে আধুনিক বাস নামাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।   

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) একটি সূত্রে পাওয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, ২০১০ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত রাজধানীতে চলাচলের জন্য ১০ হাজার ১৩৪টি যাত্রীবাস রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়েছে। যেগুলো বিআরটিএ মিনি বাস হিসেবে রেজিস্ট্রেশন দিয়ে থাকে।

পরিবহন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রতিদিন তাদের গাড়িপ্রতি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয় বিভিন্ন স্পটে। আর রাস্তায় চলাচলকারী লেগুনা গাড়িগুলোকে প্রতিদিন চাঁদা গুনতে হয় ৮০০ টাকা। সেই হিসাবে মহানগরীতে প্রতিদিন বাস ও লেগুনা থেকে কম হলেও অর্ধকোটির বেশি টাকা চাঁদা আদায় হয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে প্রায় ২০টি স্পট রয়েছে চাঁদা আদায়ের জন্য। শ্রমিক ফেডারেশনের নামে বিভিন্ন ব্যানারে চাঁদার  টাকা তোলা হয়। সদরঘাট, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড, মহাখালী বাস টার্মিনাল, গাবতলী টার্মিনালসহ বেশ কয়েকটি স্পট আছে। এগুলোর নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনাল কমিটি, ফুলবাড়িয়া ওভারস্টপ কমিটি, ঢাকা জেলা যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ঢাকা জেলা বাস মিনিবাস কোচ শ্রমিক ইউনিয়ন ও মহানগরের মধ্যে যে সিটি করপোরেশন আছে (ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন)।

পরিবহন শ্রমিকরা জানান,  চাঁদা তোলার ভিন্ন ভিন্ন কৌশল আছে। কিছু কিছু স্পটে বাসযাত্রা শুরুর আগেই দিতে হয় চাঁদা। আবার কিছু স্পটে একটা ট্রিপ শেষ করেই চাঁদার পুরো টাকা দিতে হয়। গাড়িতে ওয়েবিল নামে যে কাগজটি থাকে, সেখানে একটি স্বাক্ষর দিয়ে চাঁদা আদায় হয়েছে তার প্রমাণ রাখা হয়। যেসব ওয়েবিলে এ রকম স্বাক্ষর থাকে না, সেই গাড়ি সড়কে কোনোভাবেই চলাচল করতে পারে না। ওয়েবিলই হচ্ছে চাঁদা আদায়ের একধরনের রসিদ। যারা চাঁদাবাজির মূল নিয়ন্ত্রক, তাদের নিয়োগ দেওয়া একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন রুটের নির্দিষ্ট স্পটগুলোতে ওয়েবিলে স্বাক্ষর আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় এই চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটের কার্যক্রম চলছে।  

নাম প্রকাশ করা না করার শর্তে ডেমরা রোড থেকে মিরপুর রুটে চলাচলকারী বাসমালিক বলেন, ‘বাস ব্যবসা আগের মতো লাভজনক নয়। জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন আমাদের সড়কে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হচ্ছে। এই চাঁদাবাজি বহুদিন ধরে এভাবেই চলছে। তাতে রাস্তায় গাড়ি চলাচলের নিয়মিত ব্যয় আর শ্রমিকদের বেতন-ভাতা মিটিয়ে আমাদের পক্ষে ব্যবসা চালানোই কঠিন হয়ে পড়ছে। আমার মতো যারা ছোট পরিবহন ব্যবসায়ী, তাদের এই পরিবহন সেক্টরে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধ করতে হচ্ছে।’

মুগদা থেকে মোহাম্মদপুর রুটে চলা রাজা সিটি বাসের এক মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রাজধানীর অনেক পুরনো পরিবহন ব্যবসায়ী আমি। রাজা সিটির ব্যানারে আমার গাড়ি চলত। এই ব্যানারে বাস বন্ধ হওয়ার পর আরও অন্য ব্যানারেও আমার বাস চলাচল করত। কিন্তু সড়কে চাঁদাবাজিতেই এখন সব চলে যায়। প্রতিদিন যদি ১ হাজারের বেশি টাকা চাঁদার খাতে দিতে হয়, তাহলে মাসে কী পরিমাণ অর্থ পকেট থেকে বের হয়ে যায়, সেটা সবাই বুঝতে পারছেন। আর কত টাকা আমি দিন শেষে পাই! চাঁদা আদায়ের সিন্ডিকেটের দাপটে আমার মতো ব্যবসায়ীরা এই সেক্টর থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছেন।’

পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, সড়কে চাঁদাবাজির জন্য অনেক ব্যবসায়ী পরিবহন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। তারা আশঙ্কা করছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে কমে যাবে বাসের সংখ্যা। নতুন বিনিয়োগ করার জন্য কেউ আগ্রহীও হবেন না।

ঢাকার পোস্তগোলা থেকে উত্তরা রুটে চলা আরেকটি বাস কোম্পানির  চেয়ারম্যান বলেন, ‘সড়কে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে এটা সবাই জানে। কিন্তু কেউ কোথাও কোনো অভিযোগ করে না। কারণ অভিযোগ করলে আমার বাস বন্ধ করে দেওয়া হবে।  পোস্তগোলা থেকে উত্তরায় একসময় রুট ছিল। চাঁদাবাজির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে ওই রুটে গাড়ির লাইন বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব চাঁদাবাজিতে মূলত ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সায় থাকে। তাদের ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজরা সক্রিয়। তাদের (ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির) ক্ষমতার জোরে  সম্প্রতি আমার একটি লাইনের ৫০টির মতো গাড়ি চলাচল করত। সে লাইন এখন আমার কাছ থেকে জোর করে নিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সে গাড়িগুলো বিক্রি করতে হচ্ছে। এখন তার নাম প্রকাশ করলে আমার বাকি যে বাস আছে, সেগুলোর লাইনও বন্ধ হয়ে যাবে। একটা লাইনে গাড়ি চালাতে অনেক টাকা দিতে হয়। তবেই রুট পাওয়া যায়।’

বাসসংকট থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় বাসযাত্রীদের। সাগর হোসেন নামে যাত্রাবাড়ী থেকে মগবাজার আসা এক যাত্রী বলেন, ‘এই শহরে আমাদের প্রতিনিয়ত বাসে ওঠার জন্য একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। এত বড় শহরে যেসব বাস চলে, সেগুলোর বেশিরভাগ নিম্নমানের। বছরের পর বছর এসব বাস দিয়েই চলছে পুরো পরিবহন সেক্টর।’

সড়কে চাঁদাবাজির বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, ‘কদিন আগেও ঢাকার প্রবেশপথ কাঁচপুরে কিছু জায়গায় চাঁদা তোলা হতো। আমরা খবর পেয়ে চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছি। আর বাসমালিকদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, যেন কাউকে তারা চাঁদা না দেয়।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘সড়কে বিভিন্ন নামে যারা চাঁদাবাজি করে তাদের বিরুদ্ধে পরিবহন মালিকরা যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ 

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ সভাপতি মো. হানিফ খোকন বলেন, সড়কে চাঁদাবাজির যে ঘটনা ঘটছে তা শ্রম আইন পরিপন্থী। তারা শ্রমিকদের উন্নয়নের কথা বলে চাঁদা নিলেও বাস্তবে এই অর্থ তাদের পকেটে ঢোকে। শ্রমিকদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয় না। সরকারের উচিত এই সিন্ডিকেটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় আনা।

চাঁদা নেওয়া একটি সংগঠন ঢাকা জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল্লাহ সদু বলেন, ‘সংগঠন থাকলে বদনাম থাকেই। সব দলকেই সবাই কমবেশি খারাপ বলে।’ এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘সড়কে যেসব বাস চলে সেগুলোর বেশিরভাগই যাত্রীবান্ধব নয়। দিনের পর দিন এসব ভাঙা আর ত্রুটিপূর্ণ বাস সড়কে চাঁদার বিনিময়ে চলাচল করছে। এগুলোর জন্য ভুক্তভোগী সবাই হন। যার জন্য পরিবহন শ্রমিকরা ভাড়ার নৈরাজ্য চালায় যাত্রীদের ওপর।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d