Trending

অস্থির বাজার নামমাত্র অভিযান

দেশে এখন আমনের ভরা মৌসুম। বাজারেও চালের সরবরাহে তেমন কোনো সংকট নেই। তবুও ‘স্টক ব্যবসার’ নামে নিবন্ধনবিহীন (লাইসেন্সবিহীন) ব্যবসায়ী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মজুদদারির কারসাজিতে দেশের বাজারে চালের দাম প্রকারভেদে কেজিতে অন্তত ৫-৬ টাকা বেড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে খাদ্য মন্ত্রণালয় গত বুধবার থেকে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা শুরু করে। তবে বাজার ঘুরে ট্রেড লাইসেন্স না থাকা, মূল্যতালিকা না রেখে বেশি দামে চাল বিক্রিসহ নানা অসংগতি পাওয়া গেলেও ব্যবসায়ীদের শুধু সতর্কীকরণে সীমাবদ্ধ থাকছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। আর এতে করে যে হারে চালের দাম বেড়েছে, সে তুলনায় বাজারে তেমন কোনো প্রভাব পড়তে দেখা যাচ্ছে না।

এমন পরিস্থিতিতে ভোক্তারা বলছেন, বেশি দামে চাল বিক্রি এবং মূল্যতালিকা না থাকাসহ নানা অসংগতির সত্যতা মিললেও ব্যবসায়ীদের সতর্কীকরণে সীমাবদ্ধ থাকা এটিই প্রমাণ করে যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযান লোকদেখানো।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত ৭ জানুয়ারি ভোটগ্রহণের আগের রাত থেকে দেশে চালের বাজার উত্তপ্ত। প্রকারভেদে কেজিপ্রতি ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে দাম। যদিও চলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণে আমন ধান উৎপাদন হয়েছে, তাতে বাজারে সরবরাহেও কোনো টান নেই। তারপরও উৎপাদন এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানীসহ দেশের সব জায়গাতেই বেড়েছে চালের দাম।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে আমন ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে উৎপাদন বেশি হয়েছে। তবুও গ্রহণযোগ্য কোনো কারণ ছাড়া দেশের বাজারে চালের দাম বেড়েছে। আর এর জন্য নিবন্ধনবিহীন মজুদদার ব্যবসায়ী ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করেছেন পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, নিবন্ধনবিহীন মজুদদার ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে চালের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। বছর জুড়ে চালের বাজার চড়া রাখতে আগে থেকেই এই ব্যবসায়ীরা ধান-চাল মজুদের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। সরকারের নিয়ম অনুযায়ী লাইসেন্সধারী একজন পাইকারি ব্যবসায়ী ৩০ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৩০০ টন চাল মজুদ রাখতে পারবেন। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অনেক ব্যবসায়ীই এর চেয়ে বেশি পরিমাণ ধান-চালের মজুদ করেন। আর তাদের মুনাফার ফাঁদের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের চালের পাইকারি ব্যবসায়ী নাজিম হোসেন বলেন, ‘মিলে যখন চালের দাম বাড়ে, তখন আমরা কেনার ওপর ভিত্তি করে দাম বাড়াই। কিন্তু আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ানোর জন্য অসাধু মিলার ও করপোরেট ব্যবসায়ীরা দায়ী। তারা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই চাল মজুদের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ফলে দেশের চালের বাজার হঠাৎ চড়া হয়ে যায়।’

বাজার ঘুরে দেখা যায়, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মজুদবিরোধী অভিযান শুরুর পর কোথাও কোথাও ধান-চালের দাম কিছুটা কমেছে। তবে আগেই উচ্চমূল্যে থাকা চালের দাম কমেছে সামান্যই। মানভেদে ১ থেকে দেড় টাকা কমে কেজিপ্রতি স্বর্ণা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩, নাজিরশাইল ৭০ থেকে ৮০, মিনিকেট ৬০ থেকে ৭৩ ও ব্রি২৮ জাতের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৩ থেকে ৫৪ টাকায়।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে সরু চালের দাম ৫ দশমিক ৩৮, মাঝারি চাল প্রায় ৩ এবং মোটা চালের দাম প্রায় ৪ শতাংশ বেড়েছে।

চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত বুধবার থেকে খাদ্য মন্ত্রণালয় বাজারে অভিযান বা তদারকির কাজ করলেও অনিয়মের জন্য কোনো ব্যবসায়ীকে শাস্তির আওতায় আনার খবর পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘গেল কয়েক দিন থেকেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বাজার তদারকি টিম রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে তদারকি করছে। এ সময় চাল বিক্রিতে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন বিষয় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কোনো ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ন্যূনতম অভিযোগ পেলেই তাকে প্রাথমিক পর্যায়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাজারে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। তবুও চালের বাজার হঠাৎ চড়ে বসেছে। এর জন্য পাইকারি বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী মিলারদের দায়ী করেছেন। তাদের ভাষ্যমতে, ঢাকার দোকানিরা ৩০০ টন চাল মজুদ করার সুযোগ তেমন একটা পান না। কিন্তু মিলারদের সেই সুযোগ থাকায় তারাই চালের মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। যার ফলে বাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা এর সত্যতাও পেয়েছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ পেলেই শিগগিরই অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে আবারও নামব।’

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সামর্থ্য অনুযায়ী, তারা মজুদ কারবারে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা না করতে পারলে অন্যান্য সংস্থাকে নিয়ে অভিযান চালাতে পারত। তারা সেই পদ্ধতি অবলম্বন না করে ব্যবসায়ীদের উসকে দিতে বাজার তদারকি অভিযান পরিচালনা করছেন। আমরা মনে করি, চাল ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে এটা মন্ত্রণালয়ের লোকদেখানো অভিযান।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button