Hot

আওয়ামী লীগের আমলে ব্যাংক খাত: সম্পদ থেকে আয় ১৮ বছরে সর্বনিম্নে

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতের ওপর দিয়ে বলতে গেলে সুনামি বয়ে গেছে। ব্যাংক লুটপাটের পাশাপাশি ব্যাংক দখল হয়েছে। দখল করেই লুটপাটকারীরা ক্ষান্ত হয়নি, ঋণের নামে আমানতকারীদের টাকা আত্মসাতের পাশাপাশি বিদেশে পাচার করা হয়েছে।

বিতরণ করা ঋণ ও ঋণের বিপরীতে আরোপিত সুদ তো আদায় হচ্ছেই না, উলটো সুদ মওকুফ করা হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে। ব্যাংকগুলোর মোট আয়ের সিংহভাগই আসে বিতরণ করা ঋণ ও অন্যান্য সম্পদ থেকে। এ খাতে আয় গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে চলে গেছে। এমন কি গত ১৮ বছরের মধ্যেও এ খাতের আয় এখন সর্বনিম্নে। এছাড়া মূলধন থেকেও আয় কমেছে।

ব্যাংকের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হারও কমেছে। সব মিলে ব্যাংক খাতের স্বাস্থ্য অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে। কয়েকটি ব্যাংক লুটপাটের কারণে তারল্য সংকটে পড়ে এখন আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না।

সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর আয়ের সিংহভাগই আসে সম্পদ থেকে। সম্পদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিতরণ করা ঋণ, বিনিয়োগ, ধার দেওয়া অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবসা। এছাড়াও ভাড়া ও অন্যান্য সম্পদ থেকে সীমিত পরিমাণে আয় হয়। ব্যাংকের যে মূলধন থাকে সেগুলোও বিনিয়োগ করা হয়। সেখান থেকেও কিছুটা আয় আসে। তবে তা সম্পদের তুলনায় একেবারেই নগণ্য। তবে ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান অংশই আসে সুদ বা মুনাফা খাত থেকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, গত ১৮ বছর ধরে ব্যাংক খাতে সম্পদ থেকে আয়ের হার কমছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের আমলে প্রথম ২ বছর সম্পদ থেকে আয় আগের বছরের চেয়ে সামান্য বেড়েছে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। তবে মাঝেমধ্যে বেড়েছে।

কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের সময় যে আয় ছিল ওই পর্যায়ে তারা আর পৌঁছতে পারেনি। বরং তলানিতে পৌঁছে গেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণ করে ২০০৯ সালের শুরুতে। তাদের ক্ষমতায় আসার আগের বছর ২০০৮ সালে ব্যাংকগুলোর ১০০ টাকার সম্পদ থেকে আয় করেছিল ১ টাকা ২০ পয়সা বা দশমিক ২০ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বছরে ২০০৯ সালে এ আয় ১০০ টাকা সম্পদের বিপরীতে বেড়ে দাঁড়ায় ১ টাকা ৪০ পয়সায়। পরের বছর ২০১০ সালেও আয় ১০০ টাকায় বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৮ শতাংশ বা ১ টাকা ৮০ পয়সা।

এর আগে ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে আয় ২০০৬ ও ২০০৭ সালেও দশমিক ৮০ শতাংশ থেকে দশমিক ৯০ শতাংশ ছিল। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আমলে গৃহীত সংস্কারের ফলে ব্যাংক খাতে অনেকটা শৃঙ্খলা চলে আসে। আওয়ামী লীগ সরকার এর সুফল পায় প্রথম ২ বছরে। দলটি ক্ষমতায় আসার পরই ব্যাংক খাতের সুশাসন দূর হতে থাকে।

এর প্রভাব পড়ে ২০১১ সালের সম্পদ থেকে আয় কমে ১০০ টাকায় ১ টাকা ৫০ পয়সায় দাঁড়ায়। ২০১২ সালে তা আরও কমে ১০০ টাকায় আয় হয় মাত্র ৬০ পয়সা। যা আগের ৬ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সময়ে সর্বনিম্নে। ওই সময়ে সোনালী ব্যাংকসহ ২৬টি ব্যাংকে হলমার্ক গ্রুপের ৪ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এছাড়াও আরও কিছু ছোট জালিয়াতি হয়। যে কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। একই সঙ্গে সুদ মওকুফের হিড়িক পড়ে।

এসব কারণে ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে আয় কমে যায়। এর পরের বছর ২০১৩ সালেই প্রকাশ হয়ে পড়ে বেসিক ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। এতে ৬ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এসব ঋণও পর্যায়ক্রমে খেলাপি হয়ে ব্যাংকটি অন্যতম একটি শক্তিশালী অবস্থান থেকে রুগ্ণ অবস্থানে চলে যায়। এখন পর্যন্ত ওইসব ঋণ আদায় হয়নি।

২০১৩ সালে সম্পদ থেকে আয় সামান্য বেড়ে দশমিক ৯০ শতাংশে উঠে। কিন্তু পরের বছরই অর্থাৎ ২০১৪ সালে তা কমে দশমিক ৬০ শতাংশে নেমে যায়। ২০১৫ সালে সামান্য বেড়ে দশমিক ৮০ শতাংশে উঠে। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে এই ২ বছরে সম্পদ থেকে আয় আবার কমে দাঁড়ায় দশমিক ৭০ শতাংশ করে। ওই সময়ে জনতা ব্যাংকে ক্রিসেন্ট গ্রুপের ৫ হাজার কোটি টাকা, এ্যানন টেক্স গ্রুপের ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হয়ে পড়ে। তখন এ ব্যাংকটিও সবল অবস্থান থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ।

ওই বছর থেকেই ব্যাংক দখল শুরু হয়। এর মাধ্যমে লুটপাটের গতি আরও বেড়ে যায়। একই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় টাকা পাচারের ঘটনাও। এর প্রভাবে ২০১৮ সালে সম্পদ থেকে আয় কমে তখনকার সময়ে সর্বনিম্নে অর্থাৎ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে আরও জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ফলে ব্যাংকের আয় আর বাড়েনি। মোটামুটি এর কাছাকাছিই উঠানামা করেছে আয়ের চিত্র।

২০১৯ সালে সম্পদ থেকে আয় হয় দশমিক ৪০ শতাংশ। ২০২০ সালে দশমিক ৩০ শতাংশ ও ২০২১ সালে দশমিক ৩০ শতাংশ হারে আয় হয়। ওই সময়ে করোনার ধকলের কারণে ঋণ আদায় স্থগিতের পাশাপাশি সুদও মওকুফ করা হয়। এর প্রভাবে আয় কমেছে। ২০২২ সালে আয় সামান্য বেড়ে দশমিক ৫০ শতাংশ ও ২০২৩ সালে দশমিক ৪৫ শতাংশ আয় হয়।

২০২৪ সালের মার্চে সম্পদ থেকে আয় কমে দাঁড়ায় দশমিক ২৩ শতাংশে। যা আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে তো বটেই, গত ১৮ বছরের মধ্যেও সর্বনিম্নে। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুতে সম্পদ থেকে আয় ছিল ১ দশমিক ৪০ শতাংশ। এখন তা কমে দশমিক ২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে সম্পদ থেকে আয় কমার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে জালজালিয়াতি। ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে, কিন্তু সুদ আদায় হচ্ছে না। খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বিধিবহির্ভূতভাবে সুদ মওকুফ করে দেওয়া হচ্ছে। এমন কি ব্যাংকের আয়ের খাত থেকে ভর্তুকি দিয়ে সুদ মওকুফ করা হচ্ছে। ফলে এ খাতে ব্যাংকগুলোর আয় কমে গেছে। গত ৫ বছরে সুদ মওকুফ করা হয়েছে ১০ হাজার ৩৮১ কোটি টাকা।

একই কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন থেকে আয়ও অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। গত ১৫ বছরে এ খাতে ব্যাংকগুলোর আয় ডাবল ডিজিট থেকে কমে সিঙ্গেল ডিজিটে নেমে এসেছে। ২০০৯ সালে মূলধন থেকে আয় ছিল ২১ দশমিক ৭০ শতাংশ। এখন তা কমে ৪ দশমিক ৩২ শতাংশে নেমেছে।

২০১৮ সালের আয় বাদ দিলে এটিও গত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১৮ সালে আয় এর চেয়ে কম অর্থাৎ ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ হয়েছিল। ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়ে দুই বছর অর্থাৎ ২০১২ ও ২০১৪ সালে আয় ছিল সিঙ্গেল ডিজিটে, বাকি সময়ে আয় ডাবল ডিজিটে ছিল। ২০১৮ সালে এ খাতে সর্বনিম্ন ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ হয়। এরপর ২০১৯ সালে সামান্য বেড়ে ৬ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠে। এরপর থেকে আয় নিম্নমুখী।

ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বাড়ায় ও প্রভিশন রাখার হার কমায় ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এর বিপরীতে যে হারে মূলধন রাখার কথা ব্যাংকগুলো সেটি পারছে না। কারণ তাদের ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ যে হারে বেড়েছে সে হারে আয় বাড়েনি। ফলে একদিকে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বেড়েছে, অন্যদিকে মূলধন রাখার হার কমেছে। এতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হার কমে গেছে। ফলশ্রুতিতে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকির মাত্রা বেড়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আমলে নেওয়া সংস্কারের সুফল আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাংকের সব খাতেই পেয়েছিল। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০০৯ সালে ব্যাংকগুলোর সম্পদ থেকে আয়, মূলধন থেকে আয় ও ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন রাখার হার বেড়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সে অবস্থা ধরে রাখতে পারেনি। দলীয় লোকদের নানাভাবে সুবিধা দিতে আগের আইন শিথিল করে। এতে ব্যাংকগুলো লুটপাটের কবলে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের বিপরীতে মূলধন ছিল ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

ওই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন মূলধন ছিল ২০১০ সালে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপরে তা বেড়ে ২০১৩ সালে ১১ দশমিক ১৫ শতাংশে উঠেছিল। এরপর থেকে তা উঠানামা করছে। এখন গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d