আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন: শর্তের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারীরা
- আবেদনকারীদের দলে বর্তমান কোনো পদসহ অতীতের অন্তত আরো দুটি সাংগঠনিক পদ থাকতে হবে
- নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম সভা আজ, মনোনয়ন ফরম বিতরণ উদ্বোধন করবেন শেখ হাসিনা
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন শর্তের বেড়াজালে আটকে যাচ্ছেন অনুপ্রবেশকারীরা। মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহকারীদের দলে বর্তমান কোনো পদসহ অতীতের অন্তত আরো দুটি সাংগঠনিক পদ থাকতে হবে। গত ১৫ বছরে বিরোধী মতাদর্শী বর্ণচোরা অনুপ্রবেশকারীরা নানা কৌশলে তৃণমূল আওয়ামী লীগে গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। এসব পদবি ব্যবহার করে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিতে নিয়োগসহ ব্যবসা, বাণিজ্য, ঠিকাদারিসহ সবকিছু নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছেন। মাদক ব্যবসায় জড়িত তাদেরই সিন্ডিকেট। বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন। এসব অনুপ্রবেশকারী আরো ক্ষমতাধর হতে সংসদ সদস্য পদে এখন দলের মনোনয়ন পেতে চান। তবে তাদের বর্তমান পদ থাকলেও অধিকাংশের অতীতের দুটি সাংগঠনিক পদ নেই। এ কারণে তারা নৌকার মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র ক্রয় করতে পারছেন না।
আওয়ামী লীগের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রথম সভা আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার দুপুরে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়ার স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, ‘শুক্রবার বেলা ৩টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ঢাকা জেলা ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে গঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্যদের যথাসময়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।’
জানা গেছে, আজ থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিক্রির কার্যক্রম শুরু করবে আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ফরম সংগ্রহের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হবে। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এর উদ্বোধন করবেন।
আগামীকাল শনিবার থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা ফরম সংগ্রহ করতে পারবেন। আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত টানা চার দিন (প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা) দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দেওয়ার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে আগ্রহী প্রার্থীদের ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে প্রশাসনিক বিভাগ অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট বুথ থেকে দলীয় মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগ এবং তৃতীয় তলায় রংপুর, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র বিতরণ করা হবে। কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচতলায় সব বিভাগের মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হবে। আরো বলা হয়, ‘আওয়ামী লীগের মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের কোনো ধরনের অতিরিক্ত লোকসমাগম ছাড়া প্রার্থী নিজে বা প্রার্থীর এক জন যোগ্য প্রতিনিধির মাধ্যমে আবেদনপত্র সংগ্রহ ও জমা দিতে হবে। আবেদনপত্র সংগ্রহের সময় অবশ্যই প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি সঙ্গে আনতে হবে এবং ফটোকপির ওপর মোবাইল নম্বর ও বর্তমান সাংগঠনিক পরিচয়সহ তিনটি পদ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। আগামী ২১ নভেম্বর বিকাল ৪টার মধ্যে মনোনয়নের জন্য আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বুধ বা বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এই বোর্ডের প্রধান দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। আট বিভাগের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে অন্তত চারটি বৈঠক হতে পারে। এসব বৈঠকে প্রতিটি আসন ধরে ধরে আগ্রহীদের বিষয়ে আলোচনা হবে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রতিটি ফরমের দাম ছিল ৩০ হাজার টাকা। এবার ২০ হাজার টাকা বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়েছে। গতবার ৪ হাজার ২৩টি ফরম বিক্রি হয়েছিল।
আওয়ামী লীগে ‘অনুপ্রবেশের’ বিষয়টি দেশময় আলোচিত-সমালোচিত ঘটনা। রাজাকার ও পাকবাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত শান্তি কমিটির প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন, এমন ব্যক্তি ও তাদের সন্তান-স্বজনদের কেউ কেউ নানা কৌশলে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে ঢুকে পড়েছেন। হয়ে উঠেছেন একশ্রেণির বড় নেতাদের ঘনিষ্ঠ। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই বলে আসছেন, ‘বিভিন্ন সংকটে দলের বড় নেতারা সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলেও তৃণমূল সব সময়ই সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তৃণমূলই দলের প্রাণ, মূলশক্তি।’ সেই তৃণমূল আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের টার্গেট করেছেন স্বাধীনতা ও আওয়ামীবিরোধী চিন্তাধারার ব্যক্তিরা। তারা দলে ভিড়ে ত্যাগী নেতাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে আসছেন। তৃণমূল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যারা নিবেদিতপ্রাণ বলে পরিচিত ছিলেন, দলের দুর্দিনে যারা ত্যাগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন, আজ তারাই নিপতিত হয়েছেন চরম দুর্দিনে। জানা গেছে, এ বিষয়টি আমলে নিয়ে এবার মনোনয়নে নতুন শর্ত দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলে বিরোধী মতাদর্শীদের ঢালাও অনুপ্রবেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েক বারই দলীয় নেতাদের সতর্ক করেছেন। তারপরও বিরোধী মতাদর্শীদের অনুপ্রবেশ ঠেকানো যায়নি। এ কারণে অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতারা এবার মনোনয়নবঞ্চিত হতে পারেন।
সবশেষ দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে বাদ পড়বেন অনেকেই। তালিকা চূড়ান্ত করতে চলছে শেষ মুহূর্তের যাচাই-বাছাই। গত মাসে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের অনেকে হয়তো দলীয় মনোনয়ন পাবেন না। শুধু আপনাদের মুখ দেখে মনোনয়ন দেব না। আগামী নির্বাচনে যাদের জয়ের সম্ভাবনা আছে, তাদেরই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে। প্রতি ছয় মাস পরপর করা জরিপের ভিত্তিতে আমরা আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য প্রার্থী বাছাই করছি। তবে যারা দলীয় মনোনীত প্রার্থীদের বিরোধিতা করবে, তাদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে।’