আওয়ামী লীগ প্রশ্নে বিভক্ত অভ্যুত্থানের শরিকরা
আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দলকে আগামী নির্বাচনে চায় বিএনপি– প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এমন বক্তব্যের পর রাজনীতির মাঠে তোলপাড় চলছে। এ নিয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে বিভক্তি।
যদিও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিয়ে বিএনপিকে জড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য ঠিক নয়। বিএনপি কখনোই আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে সুপারিশ কিংবা প্রস্তাব দেয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতারা নমনীয়তা দেখালেও অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব আওয়ামী লীগকে জুলাই গণহত্যার জন্য দায়ী করে রাজনীতিতে একচুল স্থান দিতে রাজি নন। তারা আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনার কথাকেও ‘অপরাধ’ মনে করেন। সরকারের উপদেষ্টারাও আভাস দিয়েছেন, ভবিষ্যতের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জায়গা নেই।
দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনে শিগগির অধ্যাদেশ আনতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয় বিএনপি– এ কথা দলটি বারবারই বলে আসছে। আদালতে গণহত্যাকারী হিসেবে প্রমাণের পর আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের চিন্তাকেও শর্তসাপেক্ষ সমর্থনের কথা বলছেন বিএনপি নেতারা।
বিএনপি প্রকাশ্যে বলছে, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ জনগণ নির্ধারণ করবে। দলটির ভাষ্য, আগামী নির্বাচনে অংশ নিলেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে নৃশংসতা, বিরোধীদের ওপর নিপীড়ন, লুটপাট, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং জুলাই গণহত্যার কারণে জনগণ আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করবে।
শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনে গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বিএনপির এই ভাষ্যকে গ্রহণ করছেন না। জাতীয় নাগরিক কমিটিরও একই অবস্থান। এ দুই সংগঠনের নেতাদের বিশ্লেষণ, বিএনপি দ্বিদলীয় ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে চাইছে। দলটি নির্বাচনের জন্য উদগ্রীব। দ্রুত নির্বাচন আদায়ে আওয়ামী লীগকে হাতেও রাখতে চাইছে। সরকার ও অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বকে চাপে রাখতেই দলটির এই কৌশল। এ কারণে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ, সংবিধান পুনর্লিখনে রাজি হয়নি। বিএনপি এমন কিছুতেই রাজি নয়, যাতে নির্বাচন দেরি হতে পারে।
তবে বিএনপি সূত্রের খবর, আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারালেও দলটিকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে বিতর্ক হবে। তাই একতরফা নয়, আওয়ামী লীগকে ভোটে হারিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। যাতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে কোথাও প্রশ্ন না ওঠে। যে প্রশ্ন তিনটি বিতর্কিত পাতানো নির্বাচনের কারণে গত ১১ বছর আওয়ামী লীগকে তাড়া করেছে, এর মুখে পড়তে চায় না বিএনপি।
জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখপাত্র শামান্তা শারমিন সমকালকে বলেন, বিচারের আগে আওয়ামী লীগের কোনো স্থান নেই। এর আগে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন, ভোটে আনার কথা বলা অপরাধ। আওয়ামী লীগ যদি সামাজিকভাবে ফিরতে চায়, তবে গণহত্যা স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে।
আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবে কিনা– এমন প্রশ্নে ড. ইউনূস সম্প্রতি ভারতীয় একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘এটা ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা রাজনৈতিক দলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। বিএনপি এটা করেছে। বলেছে, সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। সুতরাং তারা ইতোমধ্যে রায় দিয়ে দিয়েছে। আমরা দেশের একটি প্রধান দলের মতামতকে উপেক্ষা করব না।’
তাহলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণে আপত্তি নেই– এমন প্রশ্নে ওই সংবাদমাধ্যমকে সরকারপ্রধান বলেন, ‘কোনো একটি দল বা আরেকটি দলকে বেছে নেওয়ার জন্য আমি কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি নই। আমি রাজনীতিকদের আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে সহায়তা করছি।’
বিএনপিই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে চাইছে– প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে ছাত্র নেতৃত্ব। অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটানো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে সরকারে আসা স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে যখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের কথা বলি, তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তৃতায় সেটি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ১৯৪৫ সালে জার্মানির ফ্যাসিস্ট নাৎসি পার্টিকে যদি নিষিদ্ধ করা হয় এবং এখনও তারা নিষিদ্ধ রয়েছে; সেখান থেকেই বোঝা উচিত আওয়ামী লীগের পরিণতি কী হওয়া উচিত।’
মির্জা ফখরুল সমকালকে বলেন, ‘বিএনপি সব সময় বলেছে– কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ কিংবা তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে জনগণ। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে। রাজনৈতিক চর্চা বাধাগ্রস্ত না হলে দেশের জনগণ যে কোনো দলের অপকর্মের জবাব দেবে এবং ফ্যাসিবাদী দলের কর্মকাণ্ডের মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করবে।’
তাহলে প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির নাম নিয়ে কেন আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা বিষয়ে বললেন– প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেন, ‘ড. ইউনূস কেন এবং কোন প্রেক্ষাপটে এমন বক্তব্য দিয়েছেন, তা জানি না। তাঁর এ বক্তব্য সঠিক নয়। বিএনপি কখনোই এ ধরনের কথা বলেনি।’
অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নাকচ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘দলটি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া, জনবিরোধী কার্যকলাপে জনসাধারণ ও তরুণ প্রজন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। একটি দল যখন আমলাতন্ত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর খুব বেশি নির্ভর করে, তখন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ঘৃণিত দলে পরিণত হয়েছে। জনগণই আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।’
এর আগে এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব বলেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকেই নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। জামায়াতকে নিষিদ্ধের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটি ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত ছিল না। ফলাফল কী হয়েছে? জামায়াত এখন রাজনীতিতে ফিরেছে।’
তবে গতকাল মঙ্গলবার এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল স্পষ্ট করেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পক্ষপাতী না হলেও শেখ হাসিনা যাতে আর ক্ষমতায় ফিরতে না পারেন, সেই ব্যবস্থা চান। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুন, তা বিএনপি চায় না। আমরা চাই না আওয়ামী দুঃশাসন ফিরে আসুক।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর প্রায় ১৫ বছরের আন্দোলনের পর গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির মাধ্যমে অভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়। এতে বিএনপি, জামায়তসহ সব বিরোধী দল এবং জনসাধারণের সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ছিল। অভ্যুত্থানকারীদের ধাওয়ায় ৫ আগস্ট গণভবন ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।
ছাত্রনেতৃত্বের সন্দেহ আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন করতে চাইছে ভারত। দ্রুত নির্বাচনের জন্য একটি সমঝোতায় যেতে চাইছে বিএনপি। সেদিকে ইঙ্গিত করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘ছেলেদের রক্তের ওপর পা রেখে দিল্লিকে কিবলা বানিয়ে ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জনগণের মুক্তির নিয়তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। আওয়ামী পুনর্বাসনে যারা উদ্যোগ নেবে, তাদেরকে ইতিহাস গণশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে।’
জুলাই গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনার দলকে দায়ী করে হাসনাত নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে লিখেছেন, যারা অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে, তারা আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করার দাবি ছাড়া আওয়ামী লীগ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আর কোনো দ্বিতীয় বক্তব্য দিতে পারে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক শীর্ষ নেতা সারজিস আলমও খোলাখুলি ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি ভেরিফায়েড ফেসবুকে অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘গণহত্যার বিচারের আগে আওয়ামী লীগকে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেব না। প্রয়োজনে দ্বিতীয় অভ্যুত্থান হবে।’
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে আজ বুধবার ‘কফিন মিছিল’ কর্মসূচি করবে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা। অন্তর্বর্তী সরকার আইনি পথে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের পথে যাচ্ছে বলে আভাস দিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ থাকলে ও আদালত মনে করলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করতে পারবে। এমন বিধান রেখে আইন সংশোধনীর অধ্যাদেশের খসড়া তৈরি হয়েছে।
আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে– এ নিয়ে বিএনপির মধ্যে সংশয় রয়েছে বলে দলীয় সূত্রের খবর। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, কোনো দল, সংগঠনের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সংবিধানের ৪৭ ধারায় সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে রায় দিলে এর সাংবিধানিক ভিত্তি থাকবে এবং আইনিভাবে সমর্থনযোগ্য হবে। তবে ট্রাইব্যুনাল সংশোধনের পুরো বিষয়টি অবগত হওয়ার পর বিস্তারিত মন্তব্য করা উচিত হবে।