আওয়ামী লীগ শরিকরাও দ্বিধায়
নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়ে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে ২৬টি দল। এর মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য দলগুলো বলেছে, নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই। এ নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতাসীনদের জোট শরিকরাও রয়েছে। কোনো কোনো দলের নেতারা বলেছেন, পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করছেন, অনুকূল হলে নির্বাচনে যাবেন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলছেন, পরিস্থিতি যে রকম তাতে নির্বাচনের পরিবেশ অনুকূল সে কথা বলা যাবে না। এর আগে নির্বাচন কমিশনও অনুকূল পরিবেশ নেই বলে জানিয়েছিল।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিবন্ধিত ৪৪টি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঠানো চিঠি তাদের বন্ধ কার্যালয়ের গেটে ঝুলিয়ে রেখে আসা হয়। বিএনপি বাদে আরও ১৭টি দল ইসির আলোচনায় অংশ নেয়নি।
বিএনপি ও সমমনা ৩৮টি দল ছাড়া জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সরকারকে পদত্যাগ করে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। বিএনপির গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। বিএনপি গত কয়েকদিনের কর্মসূচিতে সহিংসতায় একজন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৯ জন নিহত হয়েছে। আজ রবিবার থেকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করতে দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানায়। গতকাল সকালে ও বিকেলে দুই ভাগে ২৬টি দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে কমিশন।
আলোচনা শেষ করার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আমরা নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার আয়োজন করেছিলাম। এখন পর্যন্ত আমরা আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে যেসব প্রস্তুতি নিয়েছি, সেসব তাদের জানিয়েছি এবং তাদের মতামত নিয়েছি।’
সিইসি বলেন, কিছু কিছু দলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, ‘নির্বাচনের পরিবেশটি এখনো অনুকূলে নয়, আমরা সেটা স্বীকার করেছি। আসলে পরিবেশটা অনুকূল-প্রতিকূল হওয়াটা আপেক্ষিক। রাজনৈতিক যে সংকট রয়েছে, সেটা নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা সব সময় ইতিবাচক। কিন্তু সেই সংকটগুলো নিরসন করার সামর্থ্য আমাদের নেই। আমরা তাদের বলেছি, আপনারা নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারতেন।’
তিনি বলেন, ‘আমি দলগুলোর নেতাদের বলেছি, আমাদের নির্বাচনের মধ্যে বিদেশিরা এসে অনেক পরামর্শ দিচ্ছে। কিন্তু আপনারা রাজনীতিবিদ হিসেবে দিতে পারছেন না। আপনারা তো রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে এই দায়িত্বগুলো নিতে পারতেন। সংলাপ করে নিজেদের মধ্যে একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারতেন।’ হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘কেউ কেউ মনে করেন নির্বাচন কমিশন একাই একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের সামর্থ্য সীমিত। আমরা নির্বাচন আয়োজন করি কিন্তু নির্বাচন পরিচালনার যে দায়িত্ব সেটা হস্তান্তর করে দিতে হয়। তাদের ওপর আমাদের নজরদারি থাকে কিন্তু সবচেয়ে বিশি নজরদারি থাকতে হয় রাজনীতিবিদদের। আর সেটা হয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে।’ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেন সবার সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে হয়, সেই আশা প্রকাশ করেন সিইসি।
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য আমাদের সময়টা খুব সীমিত। নির্বাচন আয়োজনের জন্য সময়টাও সংবিধান নির্ধারণ করে দিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে আমাদের নির্বাচন করতে হবে। কেউ পছন্দ করুক আর না করুক আমরা আশা করি আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করুক।’
বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘আপনারা নির্বাচনে আসুন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে সফল হোন সেই শুভকামনা আপনাদের প্রতি আমাদের থাকবে।’
যা বলেছেন ২৬ দলের প্রতিনিধিরা
ইসির সঙ্গে আলোচনায় সকালের পর্বে আওয়ামী লীগসহ ১৩টি দল অংশ নেয়। বিকেলে দ্বিতীয় পর্বেও সমসংখ্যক দল অংশ নেয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ফারুক খান বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন যে বক্তব্যগুলো দিয়েছে এবং যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে আমাদের সরকার সহায়তা করেছে, তার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখছি। আমি মনে করি সংবিধানসম্মতভাবে একটি সুুষ্ঠু নির্বাচন হবে।’
বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যাশা করি, নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হবে না। নির্বাচন কমিশনের উচিত নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করার জন্য যা যা করার দরকার, সেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা এটা আমাদের প্রত্যাশা।’
নির্বাচনী পরিবেশ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত না আসার মতো কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। তবে আমরা চাই নির্বাচনের পরিবেশ ইম্প্রুভ হোক, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন ভূমিকা রাখুক, সেটা দেখতে চাই।’
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের শীর্ষস্থানীয় নেতা সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা বলেছি, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অংশগ্রহণমূলক হয়, অবাধ ও সুষ্ঠু হয় এবং এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণ যাতে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, সে ব্যাপারে কমিশনকে অর্থবহ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
নির্বাচনের জন্য পরিবেশ সুষ্ঠু আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা যেটা মনে করছি, এখানে যেহেতু একটা রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, সেই অস্থিরতা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা শঙ্কা আছে। আমরা চাই, এই শঙ্কা থেকে দেশবাসী যেন মুক্তি পায়।’
জাতীয় পার্টির (জেপি) মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বলেছি, দেশের সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করতে পারে। অতীতে এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেই সব নির্বাচনে নির্বাচনী বিধিবিধান যেভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সে বিষয় তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।’
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘আমরা ২০১৪ ও ১৮-এর পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা চাই একটা সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও জনগণকে আস্থায় আনতে পারে এ ধরনের একটা নির্বাচনী পরিবেশ। নির্বাচন কমিশন আমাদের যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে আমরা সেগুলো পর্যবেক্ষণ করব। আমরা দেখব যে তারা বাস্তবে জনগণকে আস্থায় আনার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বলেছি, একটা গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য। সেই নির্বাচনে জনগণ যাতে আগ্রহী হয়, জনগণ যাতে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়। পাশাপাশি সব দলের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় এবং তারা যেন আস্থাবোধ করে এ ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।’
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য ছাড়া তফসিল ঘোষণা না করতে নির্বাচন কমিশনকে আহ্বান জানিয়েছে ববি হাজ্জাজের দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মোমিনুল আমিন বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের প্রতি এখন পর্যন্ত আস্থাশীল নই; সেটা তুলে ধরে আমাদের সুনির্দিষ্ট দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতেই এখানে এসেছি।’
তরীকত ফেডারেশনের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী ফারুকি বলেন, তফসিল ঘোষণার পূর্ব ও পরে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে অসংগতিপূর্ণ কর্মকান্ড করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে দাবি জানিয়েছেন তারা।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারেফ হোসেন বলেন, যারা আলোচনায় আসেনি নির্বাচন কমিশন উদ্যোগ নিয়ে তাদের আলোচনায় নিয়ে আসা উচিত। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশনকে এই উদ্যোগ নিতে হবে।
ন্যাপের কার্যকরী সভাপতি আইভি আহমদ বলেন, ‘আমি কোনো মতামত দিইনি। কয়েকটি প্রশ্ন করেছিলাম। আমি সিইসিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম নির্বাচন করার মতো অনুকূল পরিবেশ আছে কি না? সিইসি বলেছেন, এখন করার মতো অনুকূল পরিবেশ তেমন নেই। তবে সব সময় যে সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশে নির্বাচন হয়, তেমনটাও নয়। ৯৯ শতাংশ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব নয়।’
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো প্রহসনের নির্বাচন জাতি আর দেখতে চায় না। আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন।’
বাংলাদেশ কংগ্রেসের সভাপতি কাজী রেজাউল হোসেন বলেন, ভোটকেন্দ্র দলীয় প্রভাবমুক্ত হতে হবে। নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রস্তাব দিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) সভাপতি এসএম আবুল কালাম আজাদ বলেন, ইসির অধীনে নির্বাচন হবে, সরকারের অধীনে নয়। নির্বাচনের পরিবেশ ঠিক করতে কমিশনকে বলা হয়েছে।
ইনসানিয়াত বিপ্লবের মহাসচিব রায়হান রাহবার বলেন, সেনাবাহিনীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই নির্বাচন পরিচালনা করা হোক। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হোক।
সুপ্রিম পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অবরোধ চলছে, সেটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায়। আমরা সিইসিকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরির জন্য অনুরোধ করেছি।’
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার জন্য ইসির ওপর আস্থা থাকলেও দলীয় ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রশাসনের কারণে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে সংশয় আছে। নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করব।’
গণফ্রন্টের চেয়ারম্যান মো. জাকির হোসেন জানান, জাতীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচনকালীন রাজনৈতিক সরকার চান তারা। তাহলেই কেবল নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
এর আগে গত বছর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপে ডাকে কমিশন। কিন্তু বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তা বর্জন করে। পরে সংলাপে না আসা দলগুলোকে চিঠি দিয়েও জবাব পায়নি সাংবিধানিক এই সংস্থা।