আখতারুজ্জামানের নির্দেশে চারজন মিলে খুন করে আনারকে। মুম্বাই থেকে কলকাতায় উড়িয়ে আনা হয় কসাই জিহাদকে: হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা
ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারকে হত্যার জন্য অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ছক আঁকে মাস্টারমাইন্ড ও ভাড়াটে খুনিরা। ২-৩ মাস ধরে দফায় দফায় বৈঠকে বসে তারা। আনারকে দেশে নাকি কলকাতায় খুন করা হবে, কলকাতায় খুন করা হলে কোন জায়গায়, কীভাবে খুন করা হবে, কোন কৌশলে তাকে ফ্ল্যাটে ডেকে নেওয়া হবে, সেখানে কে কে খুনে অংশ নেবে এবং খুন করার পর লাশ কোন উপায়ে গুম করা হবেÑ নিখুঁতভাবে এসব পরিকল্পনা করা হয়।
খুনের জন্য ভাড়াটে খুনি ও কসাইকে আগ থেকে কলকাতায় আনা হয়। খুন করতে বিভিন্ন উপকরণও কিনে রাখে খুনিরা। লাশ গুম করতে কেনা হয় লাগেজ, পলিথিনসহ ছোট ছোট ব্যাগও। এত সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা করেও আনারকে হত্যার মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই ধরা পড়ে যায় খুনিরা।
তবে হত্যা পরিকল্পনায় সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও ফ্ল্যাট ভাড়ার ক্ষেত্রই যেন কাল হলো খুনিদের। আনারকে হত্যার জন্য কলকাতার নিউটাউনের আবাসন এলাকা সঞ্জীবা গার্ডেনসে বিইউ ৫৬ ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয়। বিলাসবহুল ওই ফ্ল্যাটে নিরাপত্তা ব্যবস্থা, সিসি ক্যামেরায় দ্রুত শনাক্ত হয়ে যায় খুনিরা। আর সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করেই খুব অল্প সময়ে বাংলাদেশে তিনজন এবং ভারতে একজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে উভয় দেশের পুলিশ।
আনার হত্যায় সরাসরি জড়িত জিহাদকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। খ- খ- লাশের টুকরো উদ্ধারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি) তাকে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালিয়েছে। তবে লাশ উদ্ধারের কোনো তথ্য জানাতে পারেনি। শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করে ১২ দিনের হেফাজতে নিয়েছে সিআইডি। আনার হত্যায় রোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছে জিহাদ। এদিকে বাংলাদেশে গ্রেপ্তার ৩ আসামিকে ৮ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবির তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, খুনের রহস্য উদ্ঘাটন হবেই। হয়তো আগে বা পরে। তবে আনার হত্যায় জড়িতরা অল্প সময়ের মধ্যেই ধরা পড়েছে। তারা বিলাসবহুল এলাকায় ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছে। এমপিকে হত্যার পর ভাগ ভাগ হয়ে তারা দেশে চলে এলেও সিসি ক্যামেরায় সব ধরা পড়ে যায়। এমপির বিষয়টি ভারতীয় পুলিশকে জানানোর পর এবং সেখানে একটি জিডি দায়ের হওয়ার পর ওই ফ্ল্যাটে কারা যাতায়াত করত, তা সিসি ক্যামেরার ফুটেজে বের করে ফেলে। এরপর দেখতে পায় সেখানে মাস্টারমাইন্ড আখতারুজ্জামান শাহীন, শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ, জিহাদ হাওলাদারসহ সবার যাতায়াত ছিল। পরে এদের খোঁজ নিয়ে ভারতীয় পুলিশ জানতে পারে, তারা এমপিকে খুনের পর বাংলাদেশে চলে আসছে। বিষয়টি আমাদের জানালে প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হয়।
কসাই জিহাদের রোমহর্ষক ॥ ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদ হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে কলকাতা সিআইডি। কলকাতা তারা বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া জিহাদ স্বীকার করেছে, আখতারুজ্জামানের নির্দেশেই সে এবং চার বাংলাদেশী মিলে আনোয়ারুল আজিমকে হত্যা করেছে।
বৃহস্পতিবার রাতে এক বিবৃতিতে এ কথা জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (সিআইডি)। বলা হয়েছে, গ্রেপ্তার সিয়ামই হচ্ছে জিহাদ। পেশায় কসাই আততায়ীরা মুম্বাই থেকে তাকে নিয়ে আসে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে মুম্বাইতে বসবাস করছিল জিহাদ। ২ মাস আগে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসে বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আখতারুজ্জামান শাহীন। সেই এই পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের হোতা।
জিহাদ জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, এমপিকে নিউটাউনের ফ্ল্যাটে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। তারপর তারা ফ্ল্যাটের মধ্যেই পুরো শরীর থেকে মাংস আলাদা করে এবং মাংসের কিমা করে। তারপর তারা সব কিছু পলিথিনের প্যাকে রেখে দেয়। পাশাপাশি হাড়গুলোকে ছোট ছোট টুকরো করে প্যাক করে। লাশের টুকরোয় মেশানো হয় হলুদের গুঁড়া। পরে সেই প্যাকেটগুলো ফ্ল্যাট থেকে বের করে, বিভিন্ন ধরনের পরিবহন ব্যবহার করে কলকাতা ও এর আশপাশের এলাকায় ফেলে দেয়।
জিহাদকে ১২ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে কলকাতা সিআইডি। শুক্রবার বেলা ১টার দিকে জিহাদকে বারাসাতের আদালতে নিয়ে আসেন সিআইডির কর্মকর্তারা। আদালতে তোলার পর তার রিমান্ডের নেওয়ার আবেদন করা হয়। এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ছিলেন শান্তময় বসু। হেফাজতের আবেদন মঞ্জুর করেন বিচারক শুভংকর বিশ্বাস।
সিআইডি জানায়, জিহাদ পেশায় একজন কসাই বলে জানা গেছে। ২৪ বছরে ওই ব্যক্তির বাড়ি বাংলাদেশের খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার বারাকপুর গ্রামে। পুলিশকে বিভ্রান্ত করতে ফেলার জন্য নিজের নাম সিয়াম বলে জানিয়েছিল জিহাদ। পরবর্তীতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নিজের সঠিক নাম এবং বাংলাদেশের ঠিকানা জানায় জিহাদ।
এর আগে তাকে নিয়ে কলকাতার নিউটাউনের পাশের ভাঙ্গর এলাকার বাগজোলা খালের কৃষ্ণমাটি সেতুর পাশে লাশের সন্ধানে তল্লাশি শুরু করে সিআইডি এবং কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টিম। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে পুলিশের বিরাট কনভয় (১৫টি গাড়ি) নিউটাউন হয়ে বাগজোলা খালের পাশে এসে দাঁড়ায়। ১০০ জনের মতো পুলিশ খালপাড়ে তন্ন তন্ন করে খ-বিখ- লাশ খুঁজতে শুরু করে। এ ঘটনায় আটক ক্যাবচালক জুবেরকে নিয়েও সেখানে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। কৃষ্ণমাটি সেতুর পাশ থেকে খন্ড খন্ড দেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে কিনা সেটি নিশ্চিত করেনি কলকাতা পুলিশ।
ভারতে গ্রেপ্তার জিহাদের ব্যাপারে তার পরিবারের দাবি, প্রায় দেড় বছর ধরে জিহাদ ভারতে পলাতক এবং সেখানে সে রঙের কাজ করত। এদিকে ভারতের পুলিশ বলছে, জিহাদ দীর্ঘদিন থেকে ভারতে ‘কসাইয়ের’ কাজ করে।
জিহাদের পরিবারের সদস্যরা জানায়, গত বছরের শুরুর দিকে যশোরের একটি মামলায় বাড়িতে ডিবি পুলিশ অভিযান চালায়। এরপর থেকে জিহাদ ও তার বড় ভাই জাহেদ হাওলাদার পলাতক রয়েছে। কয়েক মাস পর ফোন করে জিহাদ তার স্ত্রীকে জানায়, সে ভারতে রঙের কাজ করছে। এরপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ নেই। জিহাদের বিরুদ্ধে দীঘলিয়া থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন আইবির চার কর্মকর্তা ॥ দুই দেশে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের তদন্তে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও বাংলাদেশের পুলিশ সমন্বয় করে তদন্ত করছে। তদন্তকাজে বাংলাদেশ পুলিশের একটি দল কলকাতায় যাওয়ার আলাপ-আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর (আইবি) চার সদস্যের একটি দল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে এসেছে। তারা সন্ধ্যার পর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে ঢাকায় গ্রেপ্তার তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
ডিবির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. শাহিদুর রহমানের কক্ষে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্য খুনের রহস্য উন্মোচনে কলকাতা পুলিশের সঙ্গে আমরা তথ্য বিনিময় করছি। তদন্তে তারা এ পর্যন্ত যেসব তথ্য পেয়েছে, সেগুলো নিয়ে আটক তিনজনের কাছে জানতে চেয়েছে। আমরাও তাদের তদন্তে পাওয়া বিষয়গুলো সম্পর্কে জানছি।
৩ আসামি ৮ দিনের রিমান্ডে ॥ এমপি আনার হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে গ্রেপ্তার তিন আসামির ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। আসামিরা হলো- শিমুল ভূঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভূইয়া ওরফে আমানুল্যা সাইদ, তানভীর ভূঁইয়া ও শিলাস্তি রহমান। শুক্রবার তাদের আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের ওয়ারী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুল ইসলাম তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথির আদালত এ আদেশ দেন।
রিমান্ড শুনানির আগে আদালতের এজলাসে আসামিদের রাখার ডকে উঠেই অঝোরে কাঁদেন তিন আসামির মধ্যে একজন শিলাস্তি রহমান। রিমান্ড শুনানির একপর্যায়ে একজন আইনজীবী ওকালতনামায় শিলাস্তি রহমানের স্বাক্ষর নিতে গেলে তিনি সেই আইনজীবীকে বলেন, আমি কেন স্বাক্ষর করব? আমি কি আসামি নাকি? এসব বিষয়ে কিছু জানি না।
কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয়, প্রমাণ যেন না থাকে ॥ আসামিদের রিমান্ড আবেদনে বলা হয়েছে, ভিকটিম আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আখতারুজ্জামান শাহীনের ব্যবসায়িক লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। ব্যবসায়িক লেনদেনসহ কিছু বিষয় নিয়ে আজিমের ওপর শাহিনের ক্ষোভ ছিল। যা সে (ভিকটিম) জানত না। এছাড়াও শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে ভিকটিমের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্ব ছিল। তাই তারা পরিকল্পিতভাবে ভিকটিম আজিমকে দেশের বাইরে নিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেন, যেন কেউ বুঝতে না পারে। ১০ মে দেশে ফেরেন শাহীন। এ সময় তিনি আমানুল্লাহকে দায়িত্ব দিয়ে আসে কোনোভাবেই যেন কাজটা মিস না হয় এবং কোনো প্রমাণ যেন না থাকে। আবেদনে আরও বলা হয়, পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ১৩ মে আসামি শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর ও শিলাস্তি রহমানসহ পলাতক অজ্ঞাতনামা আসামিরা নৃশংসভাবে আনারকে হত্যা করে লাশ গুম করে। যাতে কোনো প্রমাণ না থাকে। এরপর তারা দেশে ফিরে আসে।
খন্ডিত লাশ নিয়ে বের হয় আমানুল্লাহ-জিহাদ ॥ এদিকে আনারকে হত্যার পর লাগেজে ভরে তার লাশ নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ পেয়েছে। ৫৮ সেকেন্ডের একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, ভারতীয় সময় ১৪ মে বিকেল ৫টা ১১ মিনিটের দিকে দুজন ব্যক্তি একটি পেস্ট কালারের ট্রলি ব্যাগ ও তিন থেকে চারটি পলিথিন ব্যাগে আনারের মরদেহ গুম করার জন্য লিফটে উঠছে। এর আগে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখা যায় আনারকে। তবে তিনি আর জীবিত ফিরতে পারেননি। বের হয়েছেন খ- খ- লাশ হয়ে ট্রলি আর পলিথিন ব্যাগে। পুরো কিলিং মিশনে সবার সামনে ছিল শিমুল ভূঁইয়া ওরফে সৈয়দ আমানুল্লাহ।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির একজন কর্মকর্তারা জানান, এমপি আনারকে হত্যার বিস্তারিত বর্ণনা শুনে তারা নিজেরাই আঁতকে উঠেন। তার পুলিশি ক্যারিয়ারে অনেক খুনের ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন, কিন্তু এত নৃশংস বর্ণনা কখনোই শোনেননি।