আগামী নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ‘মাস্তানতন্ত্র’ চলবে না : জামায়াত আমির

‘আমি মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলবো- আমরা সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করবো।’
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা কল্পনাও করা যায় না- উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেন, ‘পাটগ্রামে কী হয়েছে, কী হচ্ছে- আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। শুধু পাটগ্রাম নয়। তারা সারা বাংলাদেশকে একদম পাটগ্রাম বানিয়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা কল্পনাও করা যায় না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতগুলো মৌলিক সংস্কার অবশ্যই করতে হবে। আমরা সেই সংস্কারগুলোর কথা বলেছি। আমরা ওই সংস্কার আদায় করে ছাড়বো। এবং সুষ্ঠু নির্বাচনও আদায় করে ছাড়বো। কেউ যদি আওয়ামী ফ্যাসিবাদ আমলের মতো নির্বাচনের স্বপ্ন দেখে থাকেন। আমি মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলবো- আমরা সেই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করবো। ওই স্বপ্ন বাস্তায়ন হতে দেয়া হবে না। কোনো প্রশাসনিক ক্যু করতে দেয়া হবে না। ভোটকেন্দ্রে কোনো ‘মাস্তানতন্ত্র’ চলবে না। কালো টাকার কোনো খেলা সহ্য করা হবে না।
শুক্রবার (৪ জুলাই) সন্ধ্যায় রংপুর জিলা স্কুল মাঠে মহানগর ও জেলা জামায়াতের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। শহীদ আবু সাঈদসহ ২৪-এর জুলাই বিপ্লবে শহীদদের খুনিদের বিচার, নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ও রাজনৈতিক সংস্কার, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও মানবিক বাংলাদেশ গঠনের দাবিতে দলটির এই জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বহু ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, ‘আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে বহু ধরনের ষড়যন্ত্র আমরা লক্ষ্য করছি। বহু ধরনের কথাবার্তা ময়দানে শুনতে পাচ্ছি। বহু ধরনের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আলামত বুঝতে পারছি। আমরা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিই। এই শেখ হাসিনা তার হাতে সব বাহিনী ছিল। দুর্দান্ত প্রতাপ ছিল। জায়গায় জায়গায় নিজের লোক বসিয়েছিল। ক্যাডার মাস্তানদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিল। কিন্তু যখন জনগণের জাগরণ, জনগণের বিস্ফোরণ হয়েছে তখন কেউ তাকে রক্ষা করতে পারেনি। আমরা কথা দিচ্ছি, ফ্যাসিবাদ বিরোধী এই লড়াই ততদিন চলবে, যতদিন দেশের বুকে ফ্যাসিবাদের ন্যূনতম চিহ্ন বিদ্যমান থাকবে। ফ্যাসিবাদকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত আামদের লড়াইকে কেউ থামাতে পারবে না।
বিএনপির নেতাকর্মীদের দিকে ইঙ্গিত করে জামায়াত আমির বলেন, ‘আফসোসের বিষয় আবু সাঈদের শাহাদাতের জীবন, জীবন বাজী রাখার জীবন, জীবনকে উৎসর্গ করার জীবন এখনকার বাংলাদেশ। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কেন ধৈর্য ধরতে পারছি না। চতুর্দিকে পত্রিকার পাতা খুললে, স্যাটেলাইট মিডিয়ার সামনে দাঁড়ালে, বসলে বাংলাদেশের কোনো না কোনো এলাকায় বিভৎস কিছু মানুষের থাবা দেখতে পাচ্ছি। আমার মায়ের ইজ্জতের ওপর এই থাবা দেখছি। মানুষের জীবনের ওপরে এই থাবা দেখছি। জনগণের সম্পদের ওপর এই থাবা দেখছি। এমনকি যখন তাদের নিজেদের কোনো হুঁশ থাকে না, তখন তারা নিজের লোককে খুন করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। যদি ভাই ২৪ এর অভ্যুত্থান না হতো, তাহলে কি তোমরা মুক্ত বাতাসে আল্লাহর দেয়া জমিতে চলাফেলা করতে পারতে। আমরা বিশ্বাস করি এই আন্দোলনে সকল পর্যায়ের মানুষের সীমাহীন ত্যাগ ও কোরবানি জড়িত আছে। সবার ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। আলেম ওলামদের খুন করা হয়েছে। গুম করা হয়েছে। মানুষকে পদে পদে অপদস্ত করা হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ আলেমদের পায়ে বেড়ি পড়ানো হয়েছে। হাতকড়া পড়ানো হয়েছে। জীবন্ত শহীদ এটিএম আজহারুল ইসলামের পায়েও বেড়ি পড়ানো হয়েছে। এরা ছিল রাজনীতির নামে শিষ্টাচার বিহীন এক প্রজাতি। তারা শিষ্টাচার জানতো না বলেই তাদের অপকর্মের স্বাদ গ্রহণ করে তারা বিদায় নিয়েছে। একই ধরনের কাজ যদি আর কেউ করে, তাহলে তাদের জন্য এর চেয়েও ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে।’
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বলে কিছু মানি না- উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, ‘৫৪ বছর যারা সংখ্যালঘু নির্যাতন করে মায়া কান্না করেছিল। আমি মহান আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বলছি- সংখ্যালঘুদের সম্পদ এরাই ডাকাতি করেছে। আমার এদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু মানি না। এটা বলেই তাদের বারোটা বাজানো হয়েছে। ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। এই দেশের মাটিতে যারাই জন্মগ্রহণ করবেন, তারা সবাই সমমর্যাদার। আমাদের সংবিধান সবাইকে সেই অধিকার দিয়েছে। আমরা কথা দিচ্ছি- সংবিধান বাংলাদেশকে যা দেবে তার আমরা পাহারাদার হবো ইনশাআল্লাহ। ওরা মালিক হয়েছিল রাষ্ট্রের, আর আমরা আমরা সেবক হবো।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘আবু সাঈদ কয়েক হাজারজন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। শিক্ষা রেখে গিয়েছে। আওয়াজ তুলে গিয়েছে যে, আমাদের এই লড়াই অব্যাহত থাকবে। এই জন্য তারা বলেছে- বৈষম্যহীন একটা মানবিক সমাজ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। তাদের শ্লোগান- আবু সাইদ মুগ্ধ, শেষ হয়নি যুদ্ধ। আবু সাঈদের সঙ্গীরা তোমরা জেগে ওঠো আরেকবার। তোমরা বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলে। আমরা তোমাদের জন্যই আল্লাহর সাহায্য নিয়ে একটা নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে দিয়ে যেতে চাই। যুবকদের হাতগুলো সামনে যেন মজবুত থাকে। যাতে নির্বাচনের সময় কেউ অপকর্ম করার সুযোগ না পায়। জনগণের ভোট নিয়ে যারাই জয়ী হবেন নির্বাচনে, তাদের বরণ করার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত আছে জামায়াতে ইসলামী।
ডা: শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এমন একটি সমাজের স্বপ্ন দেখি, যে সমাজ আমাদের শহীদ সন্তানদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। সমাজে কোনো বৈষম্য থাকবে না। যেই সমাজে জাতে পাতে ধর্মে কোনো বিভক্তি থাকবে না। যে সমাজে দেশটাকে জাতিটাকে ভাগ করা হবে না। গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে দলমমত, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমরা সামনে এগিয়ে যাবো।’
জামায়াত আমির বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের বিষয়ে জাতির সামনে কিছু বিষয় উপস্থাপন করবো। সেগুলো এখনি আমরা খোলাসা করতে চাচ্ছি না। না। আশা করি- জাতি বুঝতে পারবে- বাংলাদেশ আগামীতে কী ধরনের সমাজ গড়তে চায়।’
তিনি বলেন, ‘ ৭২ সাল থেকে এই মব শুরু হয়েছে। মায়েদের স্তন কেটে মালা বানিয়ে গলায় পরেছে। এমন কুলঙ্গার এখনো বাংলাদেশে আছে। আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি। সেই নারী যেই হোক। সে আমার মা। সে আমার বোন। সে আমার মেয়ে। তার স্তন কাটা তো দূরের কথা। তার শরীরে হাত দেয়ার ক্ষমতা আল্লাহ কাউকে দেননি। সেগুলো কি মব ছিল না। জীবন্ত মানুষকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সেগুলোকি মব ছিল না। তাই বলে মবকে সমর্থন করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। কোনো নাগরিকেরই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার এখতিয়ার নেই। রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইন, সেই আইনেই তার বিচার হবে। যদি কেউ অপরাধ করে থাকে। অপরাধের বিচার করার দায়িত্ব জনগণের নয়। এই দায়িত্ব বিচার বিভাগের। বিচার বিভাগ ও নিবার্হী বিভাগ বিভাগকে সমন্বয় করে অপরাধের বিচার করবে।’
মহানগর জামায়াত আমির এটিএম আজম খানের সভাপতিত্বে এ সময় প্রধান বক্তার বক্তব্য রাখেন সদ্য কারামুক্ত কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য এটিএম আজহারুল ইসলাম, বিশেষ বক্তার বক্তব্য রাখেন নায়েবে আমির ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মজিবর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান ও আব্দুল হালিম, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, ঢাকা মহানগর উত্তর আমির মো: সেলিম উদ্দিন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য মাওলানা মমতাজ উদ্দিন ও অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বেলালসহ স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।