আগামী মাসে একই রেখায় আসবে সাত গ্রহ, কী হবে তাতে
আগামী মাসে এক বিরল দৃশ্যের সাক্ষী হতে যাচ্ছে পৃথিবীবাসী। ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতের আকাশে সাতটি গ্রহকে একসঙ্গে দেখা যাবে, যা বিরল ঘটনা।
বর্তমানে রাতের আকাশে শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন—এই ছয়টি গ্রহ দৃশ্যমান হয়। তবে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মাত্র এক রাতের জন্য আকাশে এই ছয়টি গ্রহের সঙ্গে বুধ গ্রহটিকেও দেখা যাবে।
পৃথিবীসহ আমাদের সৌর জগতের আটটি মূল গ্রহ একই কক্ষপথে থেকে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে থাকে। তবে তাদের প্রদক্ষিণ করার গতি ভিন্ন ভিন্ন হয়। সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ ৮৮ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করে থাকে। অর্থাৎ গ্রহটিতে ৮৮ দিনে এক বছর হয়। আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। আর নেপচুনের সময় লাগে ৬০ হাজার ১৯০ দিন। অর্থাৎ নেপচুন গ্রহের এক বছরের মানে হলো পৃথিবীর প্রায় ১৬৫ বছর।
গ্রহগুলোর গতি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় কখনো কখনো কিছু গ্রহ সূর্যের একই পাশে সারিবদ্ধ হয়ে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। গ্রহগুলো যদি সূর্যের ডান দিকে থেকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন সেগুলো পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হয়। অর্থাৎ আমরা রাতের আকাশে একসঙ্গে কয়েকটি গ্রহকে দেখতে পাই। তবে মাঝেমধ্যে বিরল ঘটনা ঘটে। এই সময় সবগুলো গ্রহ এমনভাবে একই রেখায় অবস্থান করে যে এগুলোকে একসঙ্গে পৃথিবী থেকে দেখা যায়।
বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি—এই পাঁচটি গ্রহ পৃথিবী থেকে খালি চোখে দৃশ্যমান হওয়ার মতো যথেষ্ট উজ্জ্বল। তবে ইউরেনাস ও নেপচুন দেখতে হলে বাইনোকুলার বা টেলিস্কোপের প্রয়োজন হয়।
সাধারণত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকলে বুধ ছাড়া সবগুলো গ্রহই পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হয়। একে গ্রহের কুচকাওয়াজ (প্ল্যানেটারি প্যারেড) বলেও ডাকা হয়ে থাকে। তবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি আবহাওয়া পরিস্থিতি ঠিক থাকলে একসঙ্গে সাতটি গ্রহকেই পৃথিবী থেকে দেখা যাবে।
যুক্তরাজ্যে ফিফথ স্টার ল্যাবস-এর জ্যোতির্বিদ জেনিফার মিলার্ড বলেন, ‘নিজের চোখে গ্রহগুলো দেখার মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। হ্যাঁ এটা ঠিক যে গুগলে খোঁজ করলে আপনারা এসব গ্রহের আরও চমৎকার সব ছবি দেখতে পাবেন। তবে এই বস্তুগুলোর দিকে তাকানোর মানে হলো আপনি এমন কিছু আলোককণার দিকে তাকাচ্ছেন যা মহাকাশের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ বা কোটি কোটি মাইল পেরিয়ে আপনার চোখের রেটিনার ওপর এসে পড়ছে।’
বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি—এই পাঁচটি গ্রহ পৃথিবী থেকে খালি চোখে দৃশ্যমান হওয়ার মতো যথেষ্ট উজ্জ্বল
তবে দেখতে চমকপ্রদ হলেও এই ধরনের বিরল ঘটনায় পৃথিবীর ওপর কি কোনো প্রভাব পড়বে? নাকি সৌরজগৎ এবং এই সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের ধারণা বাড়াতে এর কোনো ব্যবহার থাকতে পারে? এমন প্রশ্ন উঠেছে।
মিলার্ড বলেন, কেবল ঘটনাক্রমেই এগুলো তাদের কক্ষপথের এই অবস্থানে থাকে। যদিও কোনো কোনো বিজ্ঞানীর দাবি, সব গ্রহ একই রেখায় আসার কারণে পৃথিবীর ওপর প্রভাব পড়তে পারে। যদিও এই দাবিগুলোর বেশির ভাগের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দুর্বল বা একেবারেই ভিত্তি নেই।
২০১৯ সালে গবেষকেরা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সব গ্রহ একই সরলরেখায় আসার কারণে সৌর কার্যকলাপের ওপর প্রভাব পড়তে পারে। সূর্য সম্পর্কে প্রধানত যে প্রশ্নগুলো ওঠে তার একটি হলো ‘সর্বোচ্চ সৌর কার্যকলাপের সময়কাল এবং দুর্বলতম সৌর কার্যকলাপের সময়কালের মধ্যে ১১ বছরের যে চক্র’ আছে তা কিসের জন্য হয় তা নিয়ে। জার্মানির ড্রেসডেন-রোসেনডর্ফের গবেষণা কেন্দ্র হেলমহোল্টজ-জেন্ট্রামের পদার্থবিদ ফ্র্যাঙ্ক স্টেফানি মনে করেন শুক্র, পৃথিবী ও বৃহস্পতির সম্মিলিত জোয়ার-ভাটার শক্তির মধ্যে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে।
স্টেফানির মতে, সৌরজগতের প্রতিটি গ্রহের জোয়ার-ভাটার শক্তি খুবই কম হলেও দুই বা তার বেশি গ্রহ যখন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় একই রেখায় চলে আসে তখন এগুলো মিলে নক্ষত্রটির ভেতরে ছোট ঘূর্ণন তৈরি করে। এই ধরনের ঘূর্ণনকে রসবি তরঙ্গ নামে ডাকা হয়। এতে আবহাওয়া পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।
স্টেফানি বলেন, ‘পৃথিবীতে রসবি তরঙ্গের কারণে সাইক্লোন ও অ্যান্টি সাইক্লোন হয়ে থাকে। সূর্যে একই রসবি তরঙ্গ হয়।’
স্টেফানির হিসাব-নিকাশ অনুসারে শুক্র, পৃথিবী ও বৃহস্পতি গ্রহ একই সরলরেখায় আসার কারণে সৌর কার্যকলাপের সময়কাল ১১ দশমিক শূন্য ৭ বছর হবে, যা আমাদের দেখা সৌরচক্রের দৈর্ঘ্যের প্রায় সমান। তবে এই ধারণাটির ব্যাপারে সবাই একমত নন।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর সোলার সিস্টেম রিসার্চের সৌর বিজ্ঞানী রবার্ট ক্যামেরন বলেন, ‘পর্যবেক্ষণ করে যা দেখা গেছে, তাতে সৌরচক্রের পেছনে গ্রহগুলোর সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই।’ রবার্ট ক্যামেরন ২০২২ সালে এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন।