আট স্থানে নির্বাচনী সংঘাতে আহত ৬৩, চার ক্যাম্পে আগুন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের আর কদিন বাকি। নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণাকে ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনা থামছেই না। গত সোমবার রাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত আটটি স্থানে নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতায় ৬৩ জন আহত হয়েছেন।
বরিশালের বানারীপাড়ায় নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ ও পাল্টাপাল্টি হামলায় অন্তত ৪০ জন আহত হয়েছেন। খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে নৌকার প্রচারে হামলা ও গুলি ছোড়ার ঘটনায় পাঁচ নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। হামলার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা।
গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে বিভিন্ন স্থানে সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। প্রথম আলোর হিসাব অনুযায়ী, গত ১৬ দিনে ১৪৪টি জায়গায় সংঘাত ও সহিংসতার ঘটনা ঘটল।
বিভিন্ন স্থানে হামলা, সংঘর্ষ
বরিশাল-২ (বানারীপাড়া-উজিরপুর) আসনে আওয়ামী লীগের কর্মীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী গ্রাম। গতকাল বেলা আড়াইটা থেকে সোয়া তিনটা পর্যন্ত দুই দফায় পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনায় অন্তত ৪০ জন আহত ও ১২টি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ঘটনাস্থলে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ফাইয়াজুল হকের অভিযোগ, দুপুরে বাইশারী গ্রামে তাঁর সমর্থকদের একটি মিছিলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সমর্থকেরা হামলা ও গুলি চালান।
নৌকার প্রার্থীর সমর্থক বিশারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ৪০-৫০টি মোটরসাইকেল নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা হাতুড়ি, লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা চালান। এ সময় মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়।
বানারীপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের ১২টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং ৪টি ভাঙচুর করা হয়েছে। তবে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বা স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীরা কেউ আহত হয়েছেন কি না, তা জানি না।’
খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে নৌকার প্রচারণার সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা ও গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে। গতকাল সকালে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়িতে এ ঘটনা ঘটে। হামলায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক দেবব্রত তালুকদারসহ ৫ জন আহত হয়েছেন। এ সময় আওয়ামী লীগের ১১ নেতা-কর্মীকে অপহরণ করে নিয়ে গেলেও পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ ঘটনার জন্য ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ) দায়ী করেছে আওয়ামী লীগ। লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাবুল চৌধুরী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, খাগড়াছড়ি আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার পক্ষে গণসংযোগ করতে উপজেলার বর্মাছড়িতে যান আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সকাল নয়টার দিকে সন্ত্রাসীরা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর গুলি ও গুলতি ছোড়ে। গুলতির আঘাতে পাঁচজন আহত হন। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের আরও ১১ জন নেতা-কর্মীকে সন্ত্রাসীরা ধরে নিয়ে যায়। পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে ইউপিডিএফের অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা বলেন, এ ঘটনা ইউপিডিএফ ঘটায়নি। বিক্ষুব্ধ সাধারণ জনগণ এই হামলা করেছে।
নেত্রকোনা-৫ (পূর্বধলা) আসনে নৌকার প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ হোসেনের লোকজনের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাজহারুল ইসলাম ওরফে সুহেল ফকিরের নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও কর্মী-সমর্থকদের মারধরের অভিযোগ উঠেছে। এ সময় ছয়জন আহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বিশকাকুনি ইউনিয়নের বাদে পুটিকা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এ ব্যাপারে জানতে আহমেদ হোসেনের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
নওগাঁ-৪ (মান্দা) আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের পৃথক হামলায় দুই পক্ষের একজন করে কর্মী আহত হয়েছেন। গতকাল উপজেলার জোকাহাট ও তালপাতিলা এলাকায় সংঘাতের ওই ঘটনা ঘটে। স্থানীয় লোকজন জানান, গতকাল দুপুরে জোকাহাটে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্রহানী সুলতান মামুদ ওরফে গামার নির্বাচনী ক্যাম্পে নৌকার প্রার্থীর কর্মী ওসমান আলীর নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন কর্মী-সমর্থক হামলা চালান। এ সময় হামলাকারীদের মারধরে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী আজিজুল ইসলাম আহত হন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা তালপাতিলা বাজারে নৌকার প্রার্থীর কর্মী রেজাউল ইসলামের ওপর হামলা চালান।
লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে নৌকার প্রার্থী আনোয়ার হোসেন খান ও স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. হাবিবুর রহমান ওরফে পবনের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার রাতে উপজেলার দরবেশপুর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে দরবেশপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বিল্লাল হোসেনসহ উভয় পক্ষের ১০ জন আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থক কামাল হোসেন বাদী হয়ে সোমবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে রামগঞ্জ থানায় মামলা করেন।
নির্বাচনী ক্যাম্পে ভাঙচুর, আগুন
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সকালে লালপুর উপজেলার গৌরীপুর মোড়ে ক্যাম্প দুটি পোড়া দেখতে পান দুই প্রার্থীর সমর্থকেরা।
লালপুর থানা ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, গৌরীপুর উচ্চবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের মোড়ে কাছাকাছি নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলামের একটি ও স্বতন্ত্র প্রার্থী আবুল কালামের একটি নির্বাচনী ক্যাম্প ছিল। সোমবার মধ্যরাত পর্যন্ত কর্মী-সমর্থকেরা প্রচারণা শেষে বাড়ি চলে যান। গতকাল ভোরে উভয় প্রার্থীর কর্মীরা ক্যাম্পে এসে দেখেন কে বা কারা তাঁদের ক্যাম্প দুটি পুড়িয়ে দিয়েছে।
মাদারীপুর-৩ (সদরের একাংশ, কালকিনি ও ডাসার) আসনে নৌকার প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপের কর্মীদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগমের একটি নির্বাচনী ক্যাম্পে তালা ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল সকালে সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের তালতলা বাজারের ওই নির্বাচনী ক্যাম্পে থাকা কর্মীদের মারধর করে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী তাহমিনা বেগম।
ওই ঘটনায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সোহেল রানা গতকাল বিকেলে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। তবে আবদুস সোবহান গোলাপ বলছেন, তাঁর কর্মীদের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে।
জয়পুরহাট-২ (আক্কেলপুর, ক্ষেতলাল ও কালাই) আসনে নৌকার প্রার্থী হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সোমবার রাত পৌনে ১০টার দিকে আক্কেলপুর উপজেলার রায়কালী ইউনিয়নের খাঁ পাড়া মোড় ও সেখান থেকে আধা কিলোমিটার দূরের শৃগালদীঘি গ্রামের নির্বাচনী ক্যাম্প পুড়িয়ে দেওয়া হয়।