Hot

আড়ালে ছিল ৮ লাখ ৫০ হাজার দরিদ্র প্রশ্নবিদ্ধ আ.লীগ আমলের গরিবের পরিসংখ্যান

গত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল গরিবের পরিসংখ্যান। আড়াল করা হয়েছিল সাড়ে ৮ লাখ দরিদ্রের তথ্য। ২০২২ সালে করা হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভেতে দেখানো হয়েছিল দেশে দারিদ্র্য হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে। এ হিসাবে মোট দরিদ্র মানুষ ছিল ৩ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার। কিন্তু বর্তমানে প্রকাশিত পভার্টি ম্যাপে দেখা যায়, জাতীয়ভাবে মোট দারিদ্র্যের হার বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। এক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৬ লাখ ৪০ হাজার। তুলনামূলক হিসাব করলে দেখা যায়, গত সরকারের সময় তৈরি ম্যাপে ৮ লাখ ৫০ হাজার দরিদ্র মানুষের হিসাব ছিলই না। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির তথ্যের মতোই দারিদ্র্যের এই তথ্যও পরিকল্পিতভাবে কম দেখানো হয়েছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।

এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এখানে হিসাবের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের ফলে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ দরিদ্র মানুষ বেড়েছে। সংখ্যার দিক থেকে এটা একেবারে কম নয়। এর ফলে দরিদ্র মানুষের জন্য বরাদ্দ নির্ধারণ করা হলে সাড়ে ৮ লাখ কম বরাদ্দ ধরা হবে। আবার যে কোনো নীতিমালা নিলে এই মানুষগুলো বাইরে থেকে যেত। তবে এর আগে পভার্টি ম্যাপে সাধারণত জাতীয় দারিদ্র্য হার বাড়েনি। এবারই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো সংখ্যাটা বেড়েছে বলে তথ্য আড়ালের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো-মানুষের ইনকাম কমে যায়, বেকার হয়ে যাওয়া। এছাড়া মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে, পরিবারের সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মানুষ দরিদ্র হতে পারে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, প্রায় ৪ থেকে ৫ কোটি মানুষ যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছেন। কিন্তু দুদিন কাজ না পেলেই তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে তাদের অবস্থা হলো টোকা দিলেই পড়ে যাওয়ার মতো। দারিদ্র্যের স্থানান্তর নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঢাকার কাছেই মাদারীপুর। এখানে কেন দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস সেটি বড় প্রশ্ন। তবে এমন হতে পারে, আগে যারা অবস্থাসম্পন্ন মানুষ বসবাস করত তারা অন্যত্র চলে গেছেন। যারা আছেন তারা দরিদ্র।

হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে-২০২২ এর প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ শনিবার যুগান্তরকে বলেন, এখানে তথ্য আড়ালের কোনো বিষয়ই নেই। কেননা ওই সার্ভেতে বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। সুতরাং তখন জাতীয় দারিদ্র্যের হার যা এসেছিল সেটি সঠিক। এখন পভার্টি ম্যাপ করতে গিয়ে আমরা ওই সার্ভের তথ্যের সঙ্গে জনশুমারি ডাটাসেটের সেকেন্ডারি অ্যানালইসিস করেছি। এক্ষেত্রে আমরা স্মল এরিয়া ইস্টিমেট টেকনিক ব্যবহার করে দেখেছি। তখন জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। এটা অতীতের সব সার্ভের পরই করা হয়েছিল। এবারই প্রথম নয়।

গত বৃহস্পতিবার পভার্টি ম্যাপ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এতে বলা হয়েছে, দেশে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯ দশমিক ২ শতাংশে (জেলা ও উপজেলার হিসাবের ভিত্তিতে) দাঁড়িয়েছে। হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভেতে গ্রামে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ, যা পভার্টি ম্যাপে কমে হয়েছে ২০ দশমিক ৩ শতাংশ। এদিকে শহর এলাকায় দারিদ্র্যের হার বেড়েছে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আগে শহরে এ হার ছিল ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ, এখন বেড়ে হয়েছে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ম্যাপে বলা হয়েছে, দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা মাদারীপুর। এখানে দারিদ্র্যের হার ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায় এ হার ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১০ সালের সার্ভেতে এ উপজেলার দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৬ দশমিক ৬ শতাংশ। ঢাকার পল্টনে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে কম ১ শতাংশ। এ ছাড়া নোয়াখালীতে সবচেয়ে কম গরিব মানুষ বসবাস করে। এ জেলায় দারিদ্র্যের হার ৬ দশমিক ১ শতাংশ। এদিকে আগের পভার্টি ম্যাপে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা ছিল কুড়িগ্রাম। এ জেলার দারিদ্র্যের হার ছিল ৭১ শতাংশ। এবারের পভার্টি ম্যাপে এই হার দাঁড়িয়েছে ৩১ শতাংশের বেশি। সেই সঙ্গে তখন সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা কুড়িগ্রামের রাজিবপুরের দারিদ্র্য হার ছিল ৮০ শতাংশ। এখন সেটি কমে হয়েছে ৩৮ শতাংশ। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দারিদ্র্য স্থানান্তরিত হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তফা কে. মুজেরী বলেন, দারিদ্র্য বাড়ার নানা কারণ থাকতে পারে। কোভিড একটি বড় কারণ হতে পারে। এ ছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ আছে আরও নানা কারণ। দারিদ্র্য স্থানান্তরেরও বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। যেমন আগে কুড়িগ্রামে মঙ্গা ছিল। সেটি রাজনৈতিক একটি ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল। এজন্য সরকারিভাবে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণসহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে এনজিওগুলোও বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এসব কার্যক্রমের ফল হিসাবে হয়তো দারিদ্র্য কিছুটা কমতে পারে। এদিকে মাদারীপুর বন্যাপ্রবণ জেলা। ২০২২ সালের আগে এই অঞ্চলে ব্যাপক বন্যা হয়েছিল। সেই সঙ্গে নদীভাঙনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত নানা প্রভাব এসব জেলায় পড়তে শুরু করেছে। ফলে সেখানে দারিদ্র্যের হার বাড়তে পারে। এছাড়া হাওড় এলাকাগুলোতেও দারিদ্র্যের প্রকোপ আছে। তিনি আরও বলেন, দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের যে নীতিমালা আছে সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবভিত্তিক করে প্রকৃত গরিব মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। চলমান নীতিমালার পাশাপাশি প্রয়োজনে নতুন নীতিমালা নিয়ে তা কার্যকর করা প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত অর্থনীতি বিষয়ক টাস্কফোর্সের সভাপতি ড. কেএএস মুর্শিদ যুগান্তরকে বলেন, হঠাৎ করেই দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তর হওয়াটা আশ্চর্যজনক। তবে এটা বলা যায় যে, কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য নিরসনে স্বল্পমেয়াদে সরকারিভাবে নানা কর্মসূচি ছিল। সেই সঙ্গে চরের মানুষের কাছে নতুন নতুন কৃষি প্রযুক্তি গেছে। শস্য বহুমুখীকরণ হয়েছে। যেমন চরে এখন প্রচুর ভুট্টা চাষ হচ্ছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মতো ধান চাষের নতুন প্রযুক্তি গেছে চর এলাকায়। উত্তরের চরগুলোতে এখন নতুন ধরনের ফসল চাষ হচ্ছে। সেই সঙ্গে অনেক চর এলাকার মানুষ দেশের বিভিন্ন স্থানে এমনকি বিদেশেও প্রবাসী শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। এসব কারণেও দারিদ্র্য কিছুটা কমতে পারে। তবে মাদারীপুরের অবস্থা আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। কী কী কারণে খারাপ হয়েছে তা গবেষণা বা গভীর পর্যালোচনার দাবি রাখে। তিনি বলেন, মাদারীপুর ঢাকার কাছের জেলা। এ জেলার মানুষ বিদেশেও কাজ করে। অনেক রেমিট্যান্স পাঠায়। তাহলে কেন মাদারীপুর দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা হলো। এসব খতিয়ে দেখা দরকার। তবে যেসব জেলায় দারিদ্র্য হার কম সেসব জেলায়ও দরিদ্র মানুষ নেই সেটি বলা যায় না। তাই পুরো দেশের জন্য একটি সঠিক দারিদ্র্যের বেইজ লাইন করা দরকার। সেই সঙ্গে যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে অবস্থান করেন, কিন্তু যে কোনো সময় নিচে নেমে যেতে পারেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্যও একটি বেজলাইন করতে হবে।

বিবিএস বলছে, বিভাগ হিসাবে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি বরিশাল বিভাগে ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম চট্টগ্রাম বিভাগে দারিদ্র্য ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভেতে ঢাকার দারিদ্র্যের হার ছিল ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ, যা পভার্টি ম্যাপ অব বাংলাদেশ ২০২২ সার্ভেতে বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ। ঢাকার অন্যান্য এলাকার মধ্যে সবচেয়ে গরিব মানুষ বসবাস করেন কামরাঙ্গীরচরে, ১৯ দশমিক ১ শতাংশ। আদাবরে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, বাড্ডায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ, বনানীতে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ধানমন্ডি এলাকায় দারিদ্র্যের হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া গুলশানে ৩ দশমিক ২ শতাংশ, মিরপুরে ১২ দশমিক ৯, মোহাম্মদপুরে ৪ দশমিক ৬ এবং রামপুরায় দারিদ্র্যের হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ২০২২ সালে যখন হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে করা হয় তখন ২০১৬ সালের তুলনায় স্যাম্পল কম ছিল। ফলে সেটি বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত রিপ্রেজেন্ট করেছে। কিন্তু দারিদ্র্য ম্যাপের ক্ষেত্রে জনশুমারি তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে যেটি করা হয়েছে এতে দারিদ্র্য হার কিছুটা বাড়তে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d