Bangladesh

আড়ালে ৪০% ‘অলস তরুণ’

তাদের না আছে শিক্ষা, না আছে প্রশিক্ষণ, না আছে কাজ তারা ভবঘুরের মতো। আসছে না দেশের কোনো কাজে। শুধু দেশের জনসংখ্যা বাড়ানোর কাজে মুখ্য ভূমিকায় তারা। দেশের মোট তরুণের (১৫-২৪ বছর বয়সী) ৪০ শতাংশই এমন অলস ভূমিকায় রয়েছেন। সরকার তাদের চিহ্নিত করেছে, শিক্ষা, কর্ম কিংবা প্রশিক্ষণে নেই এমন তরুণ (নিট) হিসেবে। এ তরুণ জনগোষ্ঠী এমন সময়ে দেশের সম্পদ না হয়ে বোঝা হচ্ছে, যখন দেশ কর্মক্ষমতার স্বর্ণযুগে আছে। বর্তমানে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৩ ভাগের ২ ভাগই তরুণ। কিন্তু সেই তরুণদের ৪০ শতাংশই অলস বসে আছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় এই তরুণ জনগোষ্ঠী অলস সময় পার করছে। এদের কীভাবে উৎপাদনশীল জনসংখ্যায় রূপান্তরিত করা যায়, সেটাই দেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর জরিপে দেখা যায়, দেশের ৩৯ দশমিক ৮৮ শতাংশ তরুণ জনগোষ্ঠীর কোনো শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কিংবা কাজ নেই। এই জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নারী। তরুণদের মধ্যে মাত্র ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ অলস, আর তরুণীদের মধ্যে এই হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

জরিপের তথ্য বলছে, এই জনগোষ্ঠীর ৪১ দশমিক ৩ শতাংশই গ্রামে বাস করে। অন্যদিকে শহরের তরুণদের মধ্যে এমন অলস তরুণ জনগোষ্ঠী ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ।

জনশুমারি ২০২২-এর প্রতিবেদন বলছে, এ ধরনের অলস জনগোষ্ঠী রয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ১১ হাজার ৪০৪ জন।

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক এই তরুণকে অলস বলা যাবে না, তারা প্রকৃতপক্ষে সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী। তাদের কাজে লাগাতে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে দেশের শীর্ষ বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি এদের অলস বলব না, এরা (নিট) সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী। তাদের যথাযথ ব্যবহার করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। কারণ এরাই আমাদের জনমিতিক লভ্যাংশ। এই লভ্যাংশের দুই-তৃতীয়াংশই এই তরুণরা। তাদের বাদ দিয়ে জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা আমরা নিতে পারব না। এই সুযোগের জানালাও ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে। এদের কীভাবে উৎপাদনশীল জনসংখ্যায় রূপান্তরিত করতে পারি, এটিই বাংলাদেশের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত মানসম্মত শিক্ষা এগুলোর সমন্বয় করতে পারলে তাদের কাজে লাগাতে পারব। ২০৪১ সালে আমরা বলছি, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নত, অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশে পরিণত হবে। কিন্তু এগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করতে হবে।’ শিক্ষিত হয়েও বেকার অনেক : গত রবিবার প্রকাশিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে ২ কোটি ৬৮ লাখ। তাদের ৮ শতাংশই বেকার। তরুণ জনগোষ্ঠীর ৭০ দশমিক ৯ শতাংশই গ্রাম এলাকার বলে উঠে এসেছে গবেষণায়। গবেষণাটি করেছেন প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ ফেলো ড. বদরুন্নেসা আহমেদ।

বিবিএসের আরেক জরিপে দেখা যায়, দেশে যত শিক্ষা, তত বেকার। কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় এই তরুণ জনগোষ্ঠী যেহেতু শিক্ষিত বেকার হয়ে পড়ে আছে, সেহেতু অন্যরা শিক্ষাবিমুখ হয়ে পড়েছে।

সরকারি হিসাব বলছে, যাদের কোনো শিক্ষা নেই, তাদের বেকারত্ব হাজারে ১৫৩ জন, কিন্তু স্নাতক বা স্নাতকোত্তর শেষ করাদের মধ্যে বেকার হাজারে ৭৯৯ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২-এ এই চিত্র উঠে এসেছে।

এবার আসা যাক শিক্ষার স্তরের ভিত্তিতে কোন পর্যায়ে বেকার কত। জরিপের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে যারা বেকার ছিলেন, তাদের মধ্যে ১ লাখ ৫৩ হাজারের কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। এ হারটি যারা কর্মরত আছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম। যারা কমপক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছেন, তাদের মধ্যে বেকারের সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার। ৭ লাখ ৩৯ হাজার বেকার তাদের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর পার করেছেন। আবার কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাস্তর শেষ করাদের মধ্যে ৫ লাখ ৩৬ হাজার বেকার ছিলেন। একই সময়ে ৭ লাখ ৩৯ হাজার বেকার, যারা কিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কমপক্ষে স্নাতক শেষ করেছিলেন। বাদবাকি ৩৩ হাজার বেকার অন্যস্তরের। সব মিলিয়ে ২৫ লাখ ৮২ হাজার বেকার ছিলেন ২০২২ সালে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যত শিক্ষিত, তত বেকারত্বের হার এ রকম একটি দুর্ভাগ্যজনক এবং বিপজ্জনক পরিসংখ্যানের দিকে আমরা যাচ্ছি। এটাকে বিপরীতমুখী করতে গেলে আগামী দিনের অর্থনীতির যে চাহিদা, বিশেষ করে আমাদের যে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল করছি, সেখানে কোন ধরনের বিনিয়োগ আসবে, কোন ধরনের শিল্প, হালকা শিল্প আসবে, এসব শিল্পের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিলেই হবে না, এমন প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যা দিয়ে তাদের উদ্যোক্তাও বানাতে পারবে আবার দক্ষ কর্মশক্তিও হবে। অন্যথায় এ রকম হবে যে ছিলাম অশিক্ষিত বেকার, হলাম প্রশিক্ষিত বেকার।’

নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা কী : দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগানোর জন্য সরকারের অনেক সংস্থাই কাজ করছে। সব সংস্থার প্রশিক্ষণসংক্রান্ত কারিকুলাম নির্ধারণের দায়িত্বে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে থাকা জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ (এনএসডিএ)।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, সব ধরনের জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনার জন্য সংস্থাগুলোকে উৎসাহিত করছে তারা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও তারা কাজ করছে; বিশেষ করে বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে, তাদের এনএসডিএ সরকারিভাবে অর্থায়ন করছে।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এনএসডিএ সব ধরনের তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য সংস্থাগুলোকে বলে। এই প্রতিষ্ঠান সরাসরি কোনো প্রশিক্ষণ দেয় না, এটি একটি বোর্ডের মতো। কারিকুলাম তৈরি করে, যারা প্রশিক্ষণ দেয় তাদের সনদ দেওয়া এগুলোই প্রধান কাজ আমাদের। বিভিন্ন খাতে স্কিল কাউন্সিল গঠন করাও আমাদের কাজ।’

তিনি আরও বলেন, ‘তরুণ জনগোষ্ঠী যেখানেই থাকুক, সাক্ষরতাবিহীন হলেও তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার জন্য আমরা কাজ করছি। প্রচার-প্রচারণা চালাই এ ব্যাপারে। তারা (নিট) আমাদের জনমিতিক লভ্যাংশ। এটি এখন আমরা পাচ্ছি। ২০৪০ সালের মধ্যে আমরা এটি হয়তো পাব না। এ জন্য আমরা সব ধরনের সভা-সেমিনারে প্রশিক্ষণকে উৎসাহিত করছি। যারা প্রশিক্ষণ দেয়, আমরা কিছু প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়নও করছি।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button