Bangladesh

আত্নীয়-স্বজন মিলে জনতা ব্যাংকে এস আলমের ঋণ ১০ হাজার কোটি টাকা

এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের আত্মীয়-পরিজন এবং তার গ্রুপের অধীন কোম্পানিগুলো চট্টগ্রামে জনতা ব্যাংকের দুটি শাখা থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে…

আর্থিকখাতের জটিল হিসাবনিকাশের জায়গা হওয়ার কথা; তবু সেখানে হিসাবের সব যুক্তিকে উপেক্ষা করে হয়েছে চরম অনিয়ম আর দুর্নীতি। ভাবতে পারেন, আপনার মাসিক আয় এক বা দুই লাখ টাকা হওয়া সত্ত্বেও– ব্যাংক থেকে ঋণ পেয়েছেন এক হাজার কোটি টাকার বেশি? হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই ঘটেছে।

বাংলাদেশে বহুদিনের প্রচলিত এক আপ্তবাক্য হলো, ‘মামা-চাচার জোর নাই, তো চাকরিও নাই’। কিন্তু আপনার মামা যদি হন- এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ!

এই সাইফুল আলমের মতো ক্ষমতাধর মামাই খুলে দিতে পারেন তার আত্মীয়দের জন্য বিপুল অর্থপ্রাপ্তির দুয়ার। সাধারণ ঋণগ্রহীতার যে ধরনের ঋণ পেতে অনেক মাস লেগে যায়– সেখানে তার দৌলতে মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই পাওয়া যায় বিপুল অঙ্কের ঋণ।

যেমন চট্টগ্রামের তিনজন ছোট ব্যবসায়ীর কথাই বলা যাক, যারা মাসিক আয় এক লাখ বা দুই লাখ টাকার মতো সামান্য দেখালেও – প্রত্যেকে ৩৪০ কোটি টাকা করে – একইদিনে এক হাজার ২০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন জনতা ব্যাংকের আগ্রাবাদ কর্পোরেট শাখা এবং বীমা ভবন শাখা থেকে।

ব্যাংকে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে মোট ঋণ ছাড় – এই পুরো প্রক্রিয়া – মাত্র তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়। এমনকি একদিনের জন্যও ব্যাংকের শাখায় আসতে হয়নি তাদের।

টিবিএসের দেখা ব্যাংকের রেকর্ড অনুযায়ী, এই তিন ব্যবসায়ী তাঁদের প্রতিষ্ঠান–  মেসার্স আনছার এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স আদিল এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণগুলো পেয়েছেন।

ব্যাংক কর্মকর্তা ও এস আলম গ্রুপের সূত্রগুলোর মাধ্যমে টিবিএস জেনেছে যে, মুরাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ গোলাম সরওয়ার চৌধুরীর (মুরাদ) হলেন সাইফুল আলমের চাচাতো বোনের ছেলে অর্থাৎ ভাগ্নে।

আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী— সাইফুল আলম মাসুদের ফুফাতো ভাই; এবং আদিল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোস্তান বিল্লাহ আদিল তার আরেক ভাগ্নে।

জনতা ব্যাংকে হিসাব খোলার সময়ে তারা ঢেউটিনের বেচাবিক্রি এবং চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে চিনি ও ভোজ্যতেল আমদানির ব্যবসা করেন বলে উল্লেখ করেছিলেন।

অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা ডেটাবেজ সফটওয়্যার– এসাইকুডা যাচাই করে প্রতিষ্ঠান তিনটির নামে কোনো ধরণের পণ্য আমদানির রেকর্ড পাননি। এমনকী খাতুনগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে এসব প্রতিষ্ঠানের তেমন পরিচিতিও নেই।

ব্যাংকের নথিপত্রের রেকর্ড বলছে, তারা ২০২২ সালের ৩ নভেম্বরে জনতা ব্যাংকে হিসাব খোলে। এর কিছুদিন পরেই, ৬ ও ৭ নভেম্বরে তিন প্রতিষ্ঠানই ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবস্থিত – ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের অন্তত ২০টি শাখায় – মোট ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) করে।

জনতা ব্যাংক থেকে এক বছর মেয়াদী এই ঋণ নিতে ১৭ নভেম্বরে তারা এসব এফডিআর জমা দেয়।

আবেদনের এক সপ্তাহের মধ্যেই ঋণগুলো অনুমোদন দেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুস সালাম আজাদ।

জনতা ব্যাংকের তৎকালীন ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ও আগ্রাবাদ করপোরেট শাখার ইনচার্জ নুরুল মোস্তফা টিবিএসকে বলেন, ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনায় এসব ঋণ দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ঋণ দেয়ার আগে এস আলম গ্রুপের কর্ণধারের সঙ্গে সিঙ্গাপুরে বৈঠক করেন জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বড় অংকের কমিশন সুবিধা নিয়ে এসব ঋণ দেয়া হয় বলে অভিযোগ কর্মকর্তাদের।

আব্দুস সালাম এখনো জনতা ব্যাংকের এমডি পদে বহাল আছেন। এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য তার সাথে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও– রিসিভ করেননি তিনি।

জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসব এফডিআরের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেছেন, ছোট ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান কীভাবে এত অর্থ পেল? যদি এত টাকাই থাকে, তাহলে ব্যাংকে এফডিআর থাকার পরেও 
কেন চড়া সুদে ঋণের জন্য আবেদন করলো?

নাম না প্রকাশের শর্তে জনতা ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “ব্যাংকে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে ঋণ প্রস্তাব, অনুমোদন ও ছাড় – পুরো প্রক্রিয়ার সময় একদিনের জন্যও ব্যাংকের শাখায় আসেননি এই তিন ঋণগৃহীতা। বরং তাদের পক্ষে ব্যাংকের শাখা দুটিতে যাতায়াত করেন, ব্যাংকটির সাবেক কর্মকর্তা ও বর্তমানে এস আলম গ্রুপের কর্মকর্তা আবু ইউছুফ মো. মোস্তফা।”

তিনি আরও জানান, এই তিন ঋণ গ্রহীতা মোট তিন হাজার কোটি টাকার ঋণের আবেদন করেছিলেন। এরমধ্যে ১ হাজার ২০ কোটি ছাড়ের পর— গণমাধ্যমের কাছে তথ্য চলে যাওয়ায় বাকি টাকা অনুমোদন দেয়নি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ।

অন্যান্য ব্যাংক থেকেও ঋণ নিয়েছেন সাইফুল আলমের আত্মীয়রা

টিবিএসের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী জনতা ব্যাংক ছাড়াও ইসলামী ব্যাংকের চাক্তাই শাখা থেকে ১ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন।

যোগাযোগ করা হলে আনছারুল প্রথমে দাবি করেন যে তিনি জনতা ব্যাংক থেকে কোনো ঋণ নেননি। পরে ব্রাঞ্চের কথা বলার পর তিনি স্বীকার করে বলেন, এই ঋণের বিপরীতে আমার এফডিআর দেয়া আছে।
তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছু আমি নিজে দেখাশোনা করি না।  বিস্তারিত তথ্যের জন্য আমাদের কোম্পানির জিএম (মহাব্যবস্থাপকের) সঙ্গে কথা বলেন।’

মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক মুরাদ ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার কোটি টাকা, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের জুবলী রোড শাখা থেকে ১২০ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ৪৫ কোটি টাকা, এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক আনোয়ার শাখা থেকে ৩৭ কোটি ঋণ নিয়েছেন।

ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম সরওয়ার চৌধুরী মুরাদ ব্যস্ততার কথা  বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

আদিল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আদিল এবং তার স্ত্রীর ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ২ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, নিজের প্রভাব খাটিয়ে আত্নীয়-স্বজনের জন্য ঋণ পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদ। 

১৪ বছরে জনতা ব্যাংক থেকে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম

সাইফুল ইসলাম তার আত্মীয়দের ১ হাজার ২০ কোটি টাকার ঋণ পাইয়ে দিতে প্রভাব খাটানোর পাশাপাশি তার শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপও জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা শাখা থেকে ১৪ বছরে প্রায় ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক বছর পর থেকে ২০১০ থেকে এভাবে ঋণ নেওয়া শুরু করে।

২০১৫ পর্যন্ত ঋণের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ২ হাজার কোটি টাকা। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর ২০১৫ থেকে– ঊর্ধ্বতন কর্তাদের চাপে গত ৯ বছরে কমপক্ষে আরো ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে শাখাটি।

এস আলম রিফাইন্ড সুগার, এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, এস আলম সুপার এডিবল অয়েল, এবং এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের নামে এসব ঋণ নেয়া হয়েছে।

আইন লঙ্ঘন করেছে জনতা ব্যাংক

এস আলম গ্রুপকে বিপুল অংকের এসব ঋণ দিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে জনতা ব্যাংক।

একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে এস আলমকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন করেছে জনতা ব্যাংক। ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের যে সীমা, এস আলমকে দেওয়া ঋণ তার চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবেই বেশি। ব্যাংকটি এস আলমকে প্রায় ১০ হাজার কোটির বেশি ঋণ দিয়েছে। অথচ একক কোনো ঋণগ্রহীতাকে ব্যাংকের মূলধনের ২৫ শতাংশের বেশি না দেওয়ার বিধান আছে। এই ঋণ ব্যাংকটির মোট মূলধনের ৪২০ শতাংশ। যেখানে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল ২ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা।

পণ্য আমদানির বিপরীতে এসব ঋণ দেওয়া হলেও– তা শোধ করেনি এস আলম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রতিবছরে মেয়াদ বাড়িয়ে কৌশলে এগুলোকে নিয়মিত ঋণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। এমনকি নতুন করে ঋণ সুবিধার জন্য গত ২৫ জুন জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্তও হয়।

এই বিষয়ে জানতে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে কল করলেও – সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
Situs Toto
toto togel
slot toto
Toto slot gacor
bacan4d
totoslotgacor
bacan4d
bacan4d slot gacor
bacan4d login
Bacan4d
bacan4d
bacan4d bonus
Toto gacor
Toto gacor
slot gacor hari ini
bacan4d toto
bacan4d toto
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d link alternatif
slot gacor bett 200
situs toto
SITUS TOTO
toto 4d
toto gacor
Slot Toto
Slot Toto
Slot Toto
Situs toto
Slot toto
Slot Dana
Slot Dana
Judi Bola
Judi Bola
Slot Gacor
toto slot
bacan4d toto
bacan4d akun demo slot
bacantogel
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacantoto
bacan4d
Bacan4d Login
slot demo
Bacan4d Toto
toto gacor
Slot Gacor
Live Draw
Live Draw Hk
toto slot
Bacan4d slot gacor
toto macau
toto slot
Toto Gacor
slot dana
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
Slot Dp Pulsa
Bacan4d Login
toto slot
Bacansports/a>
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
bacansport
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
slot gacor
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
toto slot
slot demo
toto slot gacor
bacansports Slot toto toto slot Slot toto Slot dana Slot toto slot maxwin slot maxwin toto slot toto slot slot dana
Toto Bola
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
bacan4d
ts77casino
situs toto
slot pulsa
bacansports
situs toto
slot toto
situs toto
slot toto
situs toto
toto slot
bacansport
bacansport
bacansports
slot toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
xx1toto
situs toto
situs toto
xx1toto
toto slot
xx1toto
xx1toto
slot qriss
Slot Toto
slot dana
situs toto
slot toto
slot dana
Situs Toto Slot Gacor
xx1toto
xx1toto
bacan4d
xx1toto
xx1toto
toto slot
situs toto slot gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
toto gacor
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
situs toto
Slot Toto
Toto Slot
Slot Gacor
Slot Gacor
Slot Gacor
slot toto
Toto Slot
slot gacor
situs togel
Toto Slot