Bangladesh

আদালতপাড়ায় তোলপাড়: খোলা চিঠির বিপরীতে বিবৃতিতে সই করতে এক ডিএজি’র অস্বীকার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের ৫১১ নম্বর কক্ষ থেকে এমরানের নেমপ্লেট খুলে ফেলা হয়েছে শৃঙ্খলাভঙ্গ করায় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে : আনিসুল হক এমরান আমার কাছে কিছু জানতে চাননি, কোনো উদ্দেশ্য আছে : এ এম আমিন উদ্দিন খোলা চিঠির বিপরীতে বিবৃতিতে সবাইকে স্বাক্ষর করতে নোটিশ দেয়া হয় : এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া

জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে রাজপথ যখন উত্তাল তখন হঠাৎ করে আবির্ভাব ঘটল ড. মুহম্মদ ইউনূস ইস্যু। নোবেল বিজয়ী বিশ্ব বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের পক্ষে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৮৩ বিশ্ব নেতার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে দেয়া খোলা চিঠিকে কেন্দ্র করে মাঠের রাজনীতির ইস্যু চাপা দিয়ে শুরু হয়ে গেল বিবৃতি যুদ্ধ। বিশ্ব নেতাদের বক্তব্যকে ‘স্বাধীন সার্বভৌম দেশের বিচার ব্যবস্থার ওপর হস্তক্ষেপ’ অভিযোগ তুলে বিবৃতি দেয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। সরকারের সুবিধাভোগী পেশাজীবী, সংবাদপত্রজীবী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাজীবীরা এই প্রতিযোগিতায় কোমড় বেধে মাঠে নেমেছেন। সরকার পক্ষ্যের আইনজীবীরাও এই বিবৃতি যুদ্ধে নামাকে কেন্দ্র করে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া নামের একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্ব নেতাদের বিপক্ষে বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় এ অবস্থার অবতারণা হয় এবং পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আদালত পাড়ায় শুরু হয় তোলপাড়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্পষ্ট করে বলেছেন, ওই ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া শঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দাবি করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এমরান কাউকে খুশি করতে এমন বক্তব্য দিয়েছেন।

এদিকে শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের সময় সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলে ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা কি ক্যামেরা ট্রায়াল যে সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হবে’।

আদালত পাড়ায় গতকাল সবার মুখে মুখে আলোচনা ছিল ড. ইউসূনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিতে অস্বীকার করা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার নাম। কেউ বলছেন, ‘এমরান বিবেকের তাড়নায় ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছেন’। কেউ বলেছেন, বিবেকের বিষয় নয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি’র ভয়ে তিনি বিবৃতি দেননি। কারণ গত কয়েক বছরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ কামিয়েছেন তা ভোগ করতেই ‘ভিসা নীতি’তে পড়তে চাচ্ছেন না। কেউ বলছেন, শুধু ইমরান নয়, যারা সরকারের সুবিধা নিয়ে বৈধ-অবৈধভাবে বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন তাদের অনেকেই এমরানের পথ ধরবেন।

শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৮৩ জন বিশ্ব নেতা নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা কাযক্রম বন্ধ করে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং নিরপেক্ষ বিচারক দিয়ে বিচারের দাবি জানিয়ে গত ২৭ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর খোলা চিঠি দেন। তাদের ধারণা বাংলাদেশে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে জুলুম-নির্যাতন করা হচ্ছে। ড. ইউনূসের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক ফাস্টলেডি হিলারি ক্লিনটনসহ কয়েকজন বিশ্ব নেতা চিঠি দিয়েছেন। শুধু ইউনূস ইস্যু নয়, বিশ্ব নেতারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনকে বিতর্কিত নির্বাচন হিসেবে অবিহিত করে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি জানান। অতঃপর সরকারের সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী, পত্রিকা সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পেশাজীবীদের মধ্যে শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খুশি করতে বিশ্ব নেতাদের ভূমিকার বিরুদ্ধে বিবৃতির প্রতিযোগিতা। এতে বেঁকে বসেছেন সরকারের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল (ডিএজি) এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। তিনি বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে বিবৃতিতে সই করতে অস্বীকার করেছেন।

ইউনূসের বিপক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গতকাল মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় থেকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার নাম সম্বলিত নেমপ্লেট খুলে ফেলা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের পঞ্চম তলায় অবস্থিত ৫১১ নম্বর কক্ষে বসতেন এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। এমরান আহম্মদের নেমপ্লেট খুলে ফেলে আরেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম ফজলুল হক বলেন, এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তা হয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তাই, একজন মুক্তিযোদ্ধা ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে তার নেমপ্লেট আমি খুলে ফেলেছি। তার নেমপ্লেট অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে থাকতে পারে না বলেই আমি মনে করি।

জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান বলেন, ‘আমি আজ অফিসে যাইনি। আমি মনে করি, ড. ইউনূস একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তার সম্মানহানি করা হচ্ছে এবং এটি বিচারিক হয়রানি। তিনি আরো বলেন, খোলা চিঠির (বিবৃতি) বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরত সবাইকে এতে স্বাক্ষর করার জন্য নোটিশ করা হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন দাবি করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিশ্বনেতাদের বিবৃতির প্রতিবাদে কোনো পাল্টা বিবৃতি তৈরি করা হয়নি এবং আইন কর্মকর্তাদের সই করতেও বলা হয়নি। এরপরেও মিডিয়ার সামনে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। আসলে তার অন্য কোনো উদ্দেশ্যে আছে। কাউকে খুশি করতে তিনি এমন বক্তব্য দিয়েছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘উনাকে (এমরান) সই করতে আমি কখনো বলিনি। আমি কোনো দিন কোনো আইন কর্মকর্তা বা কাউকে সই করতে বলি না। আমাদের অফিস থেকে আমার জানা মতে, নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, কোনো বিবৃতি তৈরি করা হয়নি।’ এমরান দাবি করেছেন হোয়াটসঅ্যাপে এমন একটি নির্দেশনা (বিবৃতিতে সই) এসেছে সাংবাদিকের এমন প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘উনি (এমরান) কি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না? আমার কোনো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে? আমি নিজে করি কোনো হোয়াটসঅ্যাপ? কে কী বললো, উনি এটি বলে দিলেন। আমি তো বললাম, উনার কোনো উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্যটা জানেন, পরিষ্কার করেন, আপনারা (সাংবাদিক) নিজেরা খোঁজ নেন। নিশ্চিত উনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এটি করেছেন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ের প্রধান হচ্ছেন অ্যাটর্নি জেনারেল সাহেব। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল যদি কোনো বক্তব্য দিতে চান, যদি কোনো বক্তব্য তার দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে তাকে সেই বক্তব্য দিতে হবে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমদ ভূঁইয়ার গণমাধ্যমে বক্তব্য দেয়া কিন্তু বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়ে। আমার মনে হয় তিনি শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেছেন। তার মতামত দিতে তিনি স্বাধীন কিন্তু যখন তিনি কোনো দায়িত্ব পালন করেন সেই দায়িত্বে থাকাকালীন অফিসের সাথে তার যদি দ্বিমত হয়, এক্ষেত্রে প্রথমে তার পদত্যাগ করা উচিত। পদত্যাগ করে তার মতামত দেওয়া উচিত। কিন্তু তিনি সেটাও করেননি। বক্তব্য দিয়ে তিনি শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, আপনারা দেখবেন। এদিকে এমরানকে চাকরিচ্যুত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে বাদী কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক তরিকুল ইসলামকে জেরা করার সময় সাংবাদিকদের কক্ষ থেকে বের করে দেন বিচারক। এ সময় ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রশ্ন তোলেন, ‘এটা কি ক্যামেরা ট্রায়াল যে সাংবাদিকদের বের করে দেয়া হলো! আপিল বিভাগেও সাংবাদিকরা থাকেন। তাদের সরে যেতে বলা হয় না। তাহলে এখানে কেন?’ বিচারক বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে বিচার শেষ করতে পারব না আমরা।’ পরে বিচারক সাংবাদিকদের এজলাসের পিছনের দিকে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেন।

এর আগে ১২টা ২৬ মিনিটে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। আদালতে ড. ইউনূসের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন। অপরদিকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।

এর আগের দিন গত সোমবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় ট্রাইব্যুনালে নতুন করে প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়ায় শুনাতিতে যাবেন না বলে ঘোষণা দেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। একই মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলীকে নিয়োগ দেয়ায় তিনি বেঁকে বসেন। কিন্তু গতকাল তিনি ইউনূসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে মামলায় আইনজীবী হিসেবে অংশ নেন।

Show More

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button