Bangladesh

আনিসুল হক: (অ)বিচারমন্ত্রী যেভাবে আইনকেই শাসন করতেন

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও বিডিআর বিদ্রোহ পিলখানা হত্যা মামলা আনিসুল হককে ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠতে সহায়তা করেছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই আইন মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বিতর্কিত ১৬তম সংশোধনীর বিলের খসড়া তৈরি করে। এর মাধ্যমেই সংসদকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কয়েক দশক পুরোনো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত করা হয়। 

গত ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় শেখ হাসিনার সবচেয়ে কাছের দুই সুবিধাভোগী ব্যক্তি আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে। সেসময় তারা নৌকা-যোগে ঢাকার সদরঘাট থেকে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। 

হাসিনার মন্ত্রিসভায় আনিসুল হকই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি হাসিনার তিন মেয়াদে আইনমন্ত্রী ছিলেন। গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তৃতীয় মেয়াদে আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। শেখ হাসিনার এমন আশীর্বাদের কারণে আনিসুল হক কিন্তু নেত্রীর প্রতি ‘কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা’ জ্ঞাপন করতে ভুল করেননি। তৃতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর আনিসুল হক হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসা জানিয়ে গণমাধ্যমের কাছে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিও পাঠান। 

দীর্ঘসময় ধরে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আনিসুল হক কখনোই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী সংসদ সদস্য ছিলেন না। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে মন্ত্রীসভায় আসন পান। কিন্তু এ তিনটি নির্বাচন শুধুমাত্র শেখ হাসিনা সরকারকে তথাকথিত ‘বৈধতা’ দেওয়ার জন্য অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 

বৈধতার সংকটে ভুগতে থাকা সরকারের মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সদস্যদের একজন হলেন আনিসুল হক। সভ্য সমাজের মূলভিত্তি হিসেবে কাজ করা বিচার প্রশাসনের বিশাল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাকে। 

বিচার প্রশাসনের দ্বায়িত্ব হলো ন্যায্যতা, সমতা ও আইনের শাসনের নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখা এবং ব্যক্তির অধিকার নিশ্চিত করে তাকে সুরক্ষা দেওয়া ও বিরোধ নিষ্পত্তি করে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। 

কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসেবে আনিসুল কেমন ছিলেন? সে প্রশ্ন থেকেই যায়। 

ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্টের আইনের শাসনের সূচকে সে উত্তর পাওয়া যায়। সূচকে উঠে এসেছে বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতি। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১ এর মধ্যে শূন্য দশমিক চার দুই এবং ১০২ টি দেশের মধ্যে অবস্থান ছিল ৯৩তম। 

সর্বশেষ প্রতিবেদনে ২০২৩ সালে আইনের শাসনের সূচকে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল ১২৭তম। এসময় বাংলাদেশ ১-এর মধ্যে শূন্য দশমিক তিন আট স্কোর করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সবচেয়ে কম স্কোর করেছে। আর নেপাল শীর্ষস্থান অধিকার করে ৭১তম, শ্রীলঙ্কা ৭৭তম এবং ভারত ৭৯তম স্থান করেছে। এমনকি বিশ্বব্যাপী ৩৭টি মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যেও বাংলাদেশের স্থান ২৮তম। 
এসব সূচকে শীর্ষে অবস্থান করা দেশগুলো হলো ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ড। তাদের স্কোর বাংলাদেশের স্কোরের দ্বিগুণ।

সূচকে এমন খারাপ র‌্যাঙ্কিংই প্রমাণ করে দেশের আইনের শাসনের অবস্থা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অভাব এবং ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার এ অবস্থা। ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট অনুসারে, বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা অত্যন্ত অদক্ষ ও অস্বচ্ছ। যার কারণে দেশের বিচার প্রার্থীরা আরো দুর্ভোগে পড়ছে। 

যেসব দেশ আইনের শাসনের সূচকে ভালো সেদেশ গুলো ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচকেও ভালো। বাংলাদেশ সবসময় দুর্নীতির সূচকে খারাপ ছিল। আর এসব প্রশাসনের অনিয়ন্ত্রিত ও ব্যাপক দুর্নীতিরই ফল। 

অপরাধ বিচার ব্যবস্থার দুঃখজনক অবস্থা এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির কারণে বাংলাদেশ সাব-ইনডেক্সে মাত্র ০.৩০ এবং ০.২৯ স্কোর করেছে। এটি সাবেক আইনমন্ত্রীর দুঃখজনক ব্যর্থতারই ফল।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত রাজনৈতিকায়ণ, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাত এবং নিম্ন আদালতে কর্মরত বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করেছে। 
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিচার বিভাগের নিম্ন শাখা দুটোই হাসিনা সরকারের বিরোধী এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

আনিসুলের বিরুদ্ধে বিচারক ও ম্যাজিস্ট্রেটদের পদোন্নতি ও পোস্টিং নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিম্ন আদালতকে নিজের অধীনে রাখার অভিযোগ রয়েছে। আর সরকারের সমালোচক বা বিরোধী কেউ জামিন পেলে সংশ্লিষ্ট বিচারক ও আইনজীবিকে এর পরিণতি ভোগ করতে হতো। আইন মন্ত্রণালয়ের একটি মাত্র ফোনেই সেই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানানো হতো। 

পুলিশ হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বিরোধী দলের সদস্যদের জামিন নামঞ্জুর করা একটি অলিখিত ও স্বয়ংক্রিয় নির্দেশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদি কোনো বিচারক বা ম্যাজিস্ট্রেট আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অমান্য করে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্তের প্রচেষ্টা করতো, তাহলে তাকে অন্যত্র বদলি করা হতো বা ওএসডি (বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করে রাখা হতো।

২০১৪ থেকে চলে আসা আইন বিভাগের এমন কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে ছিলেন আনিসুল হক। তবে তার মন্ত্রী হওয়া সবার জন্য চমকপ্রদই ছিল। 

ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অনিসুল হক দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান আইনজীবী এবং বিশেষ কৌঁসুলি ছিলেন। সেসময় রাজনৈতিক এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছিল তিনি। তার কঠোর ব্যবস্থার শিকার হওয়া রাজনীতিবিদদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াও ছিলেন। 

কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে হাসিনা পুনরায় ক্ষমতায় আসেন এবং জরুরি অবস্থার সময় আনিসুল হকের সেই কঠোর ভূমিকা পরবর্তীতে কোনো প্রভাব ফেলেনি। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন আনিসুল হকের বাবা সিরাজুল হক। শুধু তাই নয় ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার প্রথম মেয়াদের প্রধান বিশেষ প্রসিকিউটর ছিলেন সিরাজুল হক। তাই বিশ্বাস করা হয়, সিরাজুল হকের কারণেই আনিসুল হকের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেননি শেখ হাসিনা।   

২০০২ সালে সিরাজুল হকের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যা মামলার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধান বিশেষ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান আনিসুল হক। ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এ মামলার শুনানি শুরু হয়। একই সময় বিডিআর বিদ্রোহ সম্পর্কিত পিলখানা হত্যা মামলার প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবেও তাকে নিয়োগ দেয় হাসিনা সরকার। 

এ দুটি মামলা তাকে ক্ষমতার সিঁড়িতে উঠতে সহায়তা করেছিল। ২০১৪ সালে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই আইন মন্ত্রণালয় সবচেয়ে বিতর্কিত ১৬তম সংশোধনীর বিলের খসড়া তৈরি করে। এর মাধ্যমেই সংসদকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রদান করা হয় এবং প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে কয়েক দশক পুরোনো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বিলুপ্ত করা হয়। 

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত মন্ত্রিসভাই আগস্টে ওই বিলের অনুমোদন দেয়। সংশোধনটি সর্বোচ্চ আদালত ও সরকারকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দেয়। যার কারণে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তিনিই ওই সংশোধনী বাতিলের প্রধান রায়দাতা ছিলেন। 

আনিসুল হক ভিন্নমতাবলম্বীদের মুখ বন্ধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর মাধ্যমে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা সংশোধন করে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই মামলা দায়ের করে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল পুলিশকে। তবে এই আইনের অপব্যবহার এতটাই ব্যাপক ছিল যে হাসিনা সরকারকে নতুন কৌশল অনুসরণ করতে হয়েছিল।

২০১৮ সালের নির্বাচনের পর সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) নিয়ে আসে। তবে এ পুরোনো আইনটি তখন নতুন মোড়কে চালু করা হয়। নতুন আইনটি বিভিন্নভাবে ৫৭ ধারা বজায় রেখেছে। এর মাধ্যমে সরকারবিরোধী ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে পুলিশকে নির্বিচারে কাজ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। দেশবিদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ব্যাপক সমালোচনার মুখে আইনমন্ত্রী হাসিনাকে ২০২৩ সালে একটি নতুন আইন আনার পরামর্শ দেন। সেই নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে একই বিধান বজায় রাখা হয়েছে। তবে শুধু শাস্তি কমানো হয়েছে। 

তবে প্রতিবারই আনিসুল হক সাইবার আইন পরিবর্তনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন এবং ন্যায্য প্রয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু আইনটির অপব্যবহারের কারণে মানুষের স্বাধীনতা সীমিত হয়ে ভয়ের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় ওয়াই চন্দ্রচূড় দুই দিনের আন্তর্জাতিক সফরে বাংলাদেশে আসেন। এখানে তিনি ‘একবিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ার সাংবিধানিক আদালত: বাংলাদেশ ও ভারতের শিক্ষা’ বিষয়ক এক সম্মেলনে অংশ নেন। 

এ সম্মেলনের ছবিতে দেখাগেছে, চন্দ্রচূড় সম্মেলনের সমাপনী দিনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রধান বিচারপদি ওবায়দুলি হাসান ও আনিসুল হকসহ অনেকের সঙ্গে একসাথে বসেছেন। আজ এই তিনজনের কেউই দায়িত্বে নেই। শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন এবং আনিসুল হক গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতি হিসেবে ব্যর্থ এবং হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে অভিযুক্ত হওয়ায় তাকেও পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। 

গত বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় বাংলাদেশের এমন সংকটাপন্ন অবস্থার প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে পারেননি চন্দ্রচূড়। তার বক্তব্যে তিনি জোর দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সংকটই প্রমাণ করে দিয়েছে যে স্বাধীনতা ও মুক্তি কতটা গুরুত্বপূর্ণ।  

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button