Bangladesh

আন্তঃসীমান্ত ৫৭ নদীতে অধিকারহারা বাংলাদেশ

আন্তঃসীমান্ত নদীর পানির একতরফা নিয়ন্ত্রণের কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রতি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আক্ষেপ বহুদিনের। দু’দেশের অনেক সীমান্ত নদীর ভারতীয় অংশের উজানে নির্মাণ করা হয়েছে ড্যাম ও ব্যারাজ। গেল আগস্টে হঠাৎ ভয়াবহ বানে ভাসল বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল। এ জন্য ভারতের বাঁধ খুলে দেওয়াকে দায়ী করছেন অনেকে। কথা নেই, বার্তা নেই হুট করে বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ার ঘটনা এবারই প্রথম নয়।

বাংলাদেশে আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা নিয়ে আছে বিভ্রান্তি। স্বীকৃত নদীর সংখ্যা ৫৭ বলা হলেও গবেষকরা দাবি করেছেন, এর বাইরে আরও ৬৯টি আন্তঃসীমান্ত নদী আছে। আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে কোথাও এর স্বীকৃতি বা নথিভুক্তি নেই। নদীর অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া এবং স্বীকৃতি না মেলায় উজানে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত। ফলে বাংলাদেশের ভাটি অংশে প্রয়োজনের সময় বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি প্রবাহিত হয় না। আবার অতিরিক্ত পানি সামলানোর নামে বর্ষা মৌসুমে বাঁধের কপাট খুলে দেওয়ায় ভাটি এলাকা বন্যায় ডোবে।
এ পটভূমিতে নানা আয়োজনে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব নদী দিবস। প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের চতুর্থ রোববার বিশ্ব নদী দিবস পালন করা হয়। এ বছর দিবসটির বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য ‘আন্তঃসীমান্ত নদীতে বাংলাদেশের অধিকার’।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যা নিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের নানা বাহানা উজানে থাকা বাংলাদেশকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
 আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় শান্তির জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক আস্থা থাকা জরুরি।

আগে থেকে তথ্য জানে না বাংলাদেশ
উজানের ঢলে প্রতিবছরই বাংলাদেশ আকস্মিক বন্যার মুখে পড়ে। কুমিল্লার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী ও ফেনীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মুহুরী নদীর উজানে ত্রিপুরা রাজ্যে একাধিক ড্যাম তৈরি করেছে ভারত সরকার, সঙ্গে রয়েছে ব্যারাজ। এভাবে নদী অববাহিকার উপনদীগুলোতেও রয়েছে একাধিক বাঁধের অস্তিত্ব। প্রবল বর্ষণে নদী অববাহিকার উজানে পানির চাপ বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ এই ড্যাম ও ব্যারাজ খুলে দিলে পানির প্রবল স্রোতে ভাটি অঞ্চল তলিয়ে যায়। অথচ এই বাঁধ খুলে দেওয়ার বিষয়টি জানে না বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক এ এস এম সাইফুল্লাহ বলেন, চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী উজানের দেশে অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে পানি ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন হলে ভাটির দেশকে বিষয়টি আগেই জানানো উচিত, যাতে ভাটির লোকজন নিজেদের প্রস্তুত করতে পারে। ভারত এবারও পানি ছাড়ার আগে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি বলে দাবি করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। অভিন্ন নদীর উজানে যদি এ বাঁধগুলো না থাকত, তাহলে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ চলমান থাকত। হুট করে এ ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে ভাটির নদীগুলো বছরের পর বছর নাব্য হারাত না। ১৯৭২ সালের মার্চে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী, সহযোগিতা এবং শান্তিচুক্তি’ সইয়ের শর্ত অনুসারে যৌথ নদী কমিশন (জেআরসি) গঠন হয়। দীর্ঘ ৫২ বছরেও পানিবণ্টনে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, তিস্তায় পানির ঘাটতির কারণে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়। এটা দেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশের সমান। এ ক্ষতি ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ১৪ শতাংশ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমাদের আন্তঃসীমান্ত নদীগুলো দেখাশোনা করার জন্য একটি জয়েন্ট রিভার কমিশন আছে। এই কমিশনের কাজ হলো, শুষ্ক মৌসুমে আমরা আমাদের অধিকার অনুযায়ী পানি পাচ্ছি কিনা, তা দেখা। পাশাপাশি বাংলাদেশের পক্ষে নেগোশিয়েট করা। সেটা গত ১৫ বছর পদ্ধতিগতভাবে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে, যেন কথা না বলতে পারে। এই কমিশনের আরেকটি কাজ– বর্ষায় যখন প্রচুর বৃষ্টি হবে, তখন বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া। ভাটিতে পানি আসার আগে পূর্বাভাস দিলে আমরা প্রস্তুতি নিতে পারি। সেটা কিন্তু হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে বন্যার কোনো পূর্বাভাস আমরা পাইনি। বাংলাদেশও সেটা নিয়ে নির্বাক।

মোহাম্মদ এজাজ আরও বলেন, গত ৫৩ বছরে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীতে ৩০ থেকে ৪০ হাইড্রো ড্যাম কমিশন হয়েছে। আন্তঃসীমান্ত নদীতে কোনো ধরনের প্রকল্প বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া ভারত করতেই পারে না।
এদিকে, এবারের বন্যার মধ্যেই ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করেন। সম্প্রতি ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও প্রধান উপদেষ্টা আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পানিবণ্টনের বিষয়টি অবশ্যই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী হতে হবে। বাংলাদেশের মতো ভাটির দেশগুলোর হিস্যা সমুন্নত রাখার সুনির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে।’

৬৯ নদীর স্বীকৃতি নেই, চুক্তি শুধু গঙ্গা নিয়েই
আন্তঃসীমান্ত (একাধিক দেশের সীমান্ত অতিক্রমকারী) নদী নিয়েও রয়েছে ভিন্ন মত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দাপ্তরিকভাবে স্বীকৃত ৫৪ আন্তঃসীমান্ত নদীর বাইরেও এ পর্যন্ত আরও অন্তত ৬৯ নদী চিহ্নিত করেছে রিভারাইন পিপল। যেগুলো ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছে কিংবা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ঢুকেছে। আন্তঃসীমান্ত নদী হিসেবে কোথাও এগুলো নথিভুক্তি নেই। বাংলাদেশে স্বীকৃত আন্তঃসীমান্ত নদী ৫৭। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের ৫৪টি ছাড়া বাকি তিনটি বইছে মিয়ানমারের সীমারেখা ধরে। এ প্রসঙ্গে নদী ও পরিবেশ নিয়ে আন্দোলন ও গবেষণায় যুক্ত অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭ বলা হলেও এর সংখ্যা অন্তত ১২৬। সরেজমিন অনুসন্ধানে প্রকৃত সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে মত দেন এই অধ্যাপক। তাঁর হিসাবে ছোট-বড় অনেক নদী ওই তালিকায় নেই।

এদিকে, বাংলাদেশ-ভারতের আন্তঃসীমান্তে অনেক নদী থাকলেও স্বাধীনতার পর দু’দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি হয়েছে কেবল গঙ্গা নদী ঘিরে। নদী ও পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, এ ধরনের বিষয় সমাধানে দু’দেশের পক্ষ থেকেই আন্তরিকতা ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে ভারতের দিক থেকে তেমনটা পাওয়া যায়নি। ফলে গঙ্গা চুক্তির পর আমরা আর কোনো নদীর পানিবণ্টন চুক্তি করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক আইনে সুরক্ষার কথা বলা আছে, তবে জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এ অনুস্বাক্ষর না করায় কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারছে না বাংলাদেশ। যদি কনভেনশনে বাংলাদেশ সই করত, তাহলে উজানের দেশ হিসেবে ভারত পানি নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করতে পারত না। আর এমন কিছু করলেও ভারত ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হতো ।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেন, ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক নদীর ওপর নিজ অধিকার স্থাপন করতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক তৎপরতার কথা ভাবতে হবে। তবে এর আগে জরুরি নিজ দেশের মানুষের কথা শোনা। আমাদের সব প্রধান নদী যেহেতু আন্তর্জাতিক, তাই অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন, এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃত।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d