আন্তর্জাতিক আদালতে আবার সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ
সরকার, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও বিভিন্ন সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) দ্বারস্থ হয়েছে লন্ডনভিত্তিক আইনি সেবা প্রতিষ্ঠান গের্নিকা ৩৭ চেম্বারস। এই প্রতিষ্ঠানের সহপ্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাজ্যের আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান। তিনি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকে আইনি সহায়তা দিয়ে থাকেন।
এর আগেও একবার টবি ক্যাডম্যান আইসিসির কৌঁসুলির কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে প্রাথমিক অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করেছিলেন।
গের্নিকা ৩৭ চেম্বারসের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ‘২০১২ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর নিরাপত্তা বাহিনী মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে’ বলে অভিযোগ করেন টবি।
২০১৬ সালের ২৫ মে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে অভিযোগ আইসিসিতে করা হয়েছিল তার কোনো আইনি ভিত্তি না থাকায় হেগের ওই আদালত তা নাকচ করেছেন।
কিন্তু গতকাল গের্নিকা ৩৭ চেম্বারসের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, তারা বলছে, ২০১৪ সালে আইসিসির কৌঁসুলির সঙ্গে যোগাযোগের ভিত্তিতে তারা নতুন করে বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এক বছর ধরে তারা বাংলাদেশে বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্য করে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত নথিভুক্ত করতে নাগরিকসমাজ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কাজ করছে বলেও ওয়েবসাইটে বলা হয়।
যোগাযোগ করা হলে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় টবি ক্যাডম্যান নতুন করে উদ্যোগ নেওয়ার কথা কালের কণ্ঠ’র কাছে স্বীকার করেন।
টবি ক্যাডম্যান বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আইনি সহায়তা দিয়েছিলেন। গের্নিকা ৩৭ চেম্বারসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত টবির জীবনবৃত্তান্তেও এই তথ্য দেওয়া আছে।
গের্নিকা ৩৭ চেম্বারস বলেছে, বাংলাদেশ আইসিসির রোম সংবিধির পক্ষ হওয়ায় সে দেশে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিচারিক এখতিয়ার আইসিসির আছে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক বা পুলিশি উদ্যোগের ওপর সাবেক ও বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ সদস্য, জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস সেন্টার, পুলিশ কমিশনার, গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল। গের্নিকা দাবি করেছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি আইসিসির অনুসন্ধানের উপযুক্ত। সরকার এবং এ দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে বিরোধীদের নিপীড়নসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছে গের্নিকা। এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল ও বাহিনীগুলোর দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির আওতায় আনার সুযোগ নেই বলেও দাবি করেছে গের্নিকা। টবি ক্যাডম্যানের এই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে ‘বাংলাদেশে ন্যায়বিচার’ নামের একটি প্ল্যাটফরমও খুলেছে।
সেসব তথ্য-উপাত্ত আইসিসির কৌঁসুলির কাছে দাখিল করার ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে কোনো অভিযোগ আইসিসির কৌঁসুলি পেয়েছেন কি না, সে বিষয়ে জানতে কালের কণ্ঠ আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তরে যোগাযোগ করেছে। গত রাত সাড়ে ৮টায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর জানিয়েছে, তারা এ বিষয়ে খুব শিগগির জানাবে।
কালের কণ্ঠ’র প্রশ্নের জবাবে টবি ক্যাডম্যান বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে বাংলাদেশের স্থানীয় আইনজীবীদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমি তখন আইনি প্রক্রিয়ার বিষয়ে সোচ্চার ছিলাম। ২০১৪ সালে আমি আইসিসির কৌঁসুলির কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করি। আর সেটিই আমাদের বর্তমান উদ্যোগের ভিত্তি।’
জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গের্নিকা ৩৭ চেম্বারসের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। গত সপ্তাহে জামায়াতে ইসলামীর আইনি প্রতিনিধি হয়ে টবি ক্যাডম্যান জামায়াতের রাজনৈতিক অধিকারের পক্ষে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর শরণাপন্ন হবেন বলে বিবৃতিও দেন। আইসিসিতে অভিযোগ করার বিষয়ে তাঁর বর্তমান উদ্যোগের পেছনেও জামায়াত আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীকে যে বিষয়গুলোতে পরামর্শ দেওয়ার নির্দেশনা পেয়েছি সেগুলো আইসিসিতে অভিযোগ দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও এর সম্পৃক্ততা নেই।’ তিনি আরো বলেন, আইসিসি যখন কোনো পরিস্থিতি তদন্ত করেন তখন তার বিচারিক এখতিয়ারে থাকা সব অপরাধ আমলে নিতে পারেন। প্রাপ্ত ও বিশ্বাসযোগ্য যেকোনো প্রমাণের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা বা যে কারো বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারেন তাঁরা।
তাহলে কার হয়ে আইসিসিতে অভিযোগ করছেন, জানতে চাইলে টবি ক্যাডম্যান বলেন, ‘এটি নাগরিকসমাজ সমর্থিত উদ্যোগ। আমাদের প্রত্যাশা, আইসিসির কৌঁসুলি বিষয়টি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে দেখবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গত রাতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা জেনেছি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার চেষ্টা চলছে। আমরা এ বিষয়ে সজাগ আছি। যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হচ্ছে তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। অতীতেও তা প্রমাণ হয়েছে। জামায়াতের অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়নি।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, অভিযোগ করার আগেই এ নিয়ে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এটির উদ্দেশ্য মামলা নয়, বরং অভিযোগ করা হচ্ছে—এই প্রচারণা চালানো। এর মাধ্যমে জনমনে সংশয় তৈরি করা। এটি আসন্ন সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের অস্থিরতা তৈরির আরেকটি অপপ্রয়াস।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘নির্বাচন সামনে রেখে বা সার্বিকভাবে আমরা যে ষড়যন্ত্রের কথা বলি এটি তারই অংশ। আমরা এ বিষয়ে সজাগ আছি, থাকব। তবে আইসিসি যদি এই অভিযোগ আমলে নেন তাহলে সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আমরা অবশ্যই তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করব।’