আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস: দারিদ্র্য কমলেও বৈষম্য কমেনি
দেশে দারিদ্র্যের হার কমলেও ভোগ ও আয়ের দিক দিয়ে বৈষম্য বেড়েছে। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, মহামারির বিরূপ প্রভাবের মধ্যেও গত ছয় বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ কমেছে। দেশে দারিদ্র্যের হার এখন ১৮.৭ শতাংশ। কিন্তু ভোগ ও আয়বৈষম্যের হার এখন উচ্চমাত্রার কাছাকাছি।
গিনি সহগ অনুযায়ী, আয়বৈষম্য বেড়ে এখন ০.৪৯৯। ভোগবৈষম্য বেড়ে ০.৩৩৪।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খানা আয় ও ব্যয় জরিপ-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে দারিদ্র্যের হার কমা ও বৈষম্য বাড়ার এই উপাত্ত। সর্বশেষ ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় কমে মোট আয়ের ১.৩১ শতাংশ হয়েছে।
যখন কোনো দেশের বৈষম্য গিনি সহগ অনুযায়ী, ০.৫০০ হয়, তখন দেশ উচ্চমাত্রার বৈষম্যে ভোগে। অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, পরিস্থিতি এখনো উচ্চমাত্রার বৈষম্যের মধ্যে না গেলেও এর কাছাকাছি রয়েছে। সরকারের এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, বিদ্যমান বৈষম্য কমানোর পাশাপাশি দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনা।
দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অসমতা দূরীকরণের লক্ষ্য নিয়ে আজ ১৭ অক্টোবর সারা দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য দূরীকরণ দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সম্মানজনক কাজ ও সামাজিক সুরক্ষা : কর্মক্ষেত্রে সবার জন্য মর্যাদা নিশ্চিত করা’।
বিবিএসের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যানে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ২৪.৩ শতাংশ। ওই বছর হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী ছিল ১২.৯ শতাংশ। সে অনুযায়ী ছয় বছরে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠী কমেছে ৭.৩ শতাংশ।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে এখন দরিদ্র জনগোষ্ঠী ২০.৫ শতাংশ এবং শহরে ১৪.৭ শতাংশ।
জরিপে দেখা যায়, দেশে আয়ের ক্ষেত্রে গিনি সহগের মান ০.৪৯৯, যা ২০১৬ সালে ছিল ০.৪৮২ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৪৫৮। এতে আয়ের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে। অন্যদিকে ২০২২ সালে ভোগ ব্যয়ের জন্য গিনি সহগের মান ছিল ০.৩৩৪, যা ২০১৬ সালে ছিল ০.৩২৪ এবং ২০১০ সালে ছিল ০.৩২১।
সাধারণত গিনি (কেউ কেউ জিনি বলেন) সহগ দিয়ে একটি দেশে বৈষম্য কেমন তা বিচার করা হয়। এটি বৈষম্য মাপার একটি পদ্ধতি। ১৯১২ সালে ইতালির সংখ্যাতত্ত্ববিদ কোরাদো গিনি বা জিনি এটি উদ্ভাবন করেন। সবার আয় সমান হলে গিনি সূচক হবে শূন্য। এর অর্থ হলো চরম সাম্য অবস্থা বিরাজ করছে। আর সব আয় একজনের হাতে গেলে সূচকটি হবে ১। এটি চরম অসাম্য অবস্থা। এই দুই সীমার মধ্যে সূচক যত বাড়ে, অসাম্য তত বেশি।
বিবিএসের উপাত্ত বলছে, দেশে ধনীদের আয় আরো বেড়েছে। এতে আয়বৈষম্য আরো বেড়েছে। যেমন দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ১০ শতাংশ মানুষের হাতে এখন মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের মাত্র ১.৩১ শতাংশ। সব মিলিয়ে সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশের দুই-তৃতীয়াংশ আয় যাচ্ছে দেশের ধনী ৩০ শতাংশ মানুষের হাতে। বাকি ৭০ শতাংশ মানুষের আয় মোট আয়ের বাকি ১ ভাগ।
ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনতে পেরেছে অনেকাংশে। এটা আমাদের বড় সফলতা। কিন্তু এখনো যে তিন কোটি ৩৩ লাখ মানুষ দরিদ্র রয়ে গেছে, সেটি সংখ্যার দিক থেকে বেশি। তবে এই সময় দেশে বৈষম্য বেড়েছে। এই বৈষম্য বাড়ার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বৈষম্য। যারা আগে শিক্ষার বেশি সুযোগ পেয়েছে, তারাই পরবর্তী সময়ে আয় বেশি করেছে। সমাজ যদি সবার সমান সুযোগ না দেয়, তাহলে এই বৈষম্য আরো বাড়বে।
মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, সমাজে বৈষম্য কমানোর জন্য সবার আগে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। সবার আগে সুযোগের ওপর বৈষম্য কমাতে হবে। তারপর সরকারকে বৈষম্য কমাতে বেশ কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম ট্যাক্স ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা, আয়কর ও সম্পত্তির কর ন্যায্যভাবে আদায় করা, যাতে রাষ্ট্র তা গরিব মানুষের মধ্যে ব্যয় করতে পারে।
বিবিএসের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে দেশের মোট আয়ের ২.৮০ শতাংশ আয় করত সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। পরের ১০-১২ বছরে এই অংশ কিছুটা বেড়েছে। এখন তা ওই সময়ের তুলনায় অর্ধেকে নেমেছে।
দেশের মানুষের আয় ও ভোগবৈষম্য বাড়ার বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপির) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কারিগরি প্রশিক্ষাণসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সঠিকভাবে সবার মধ্যে বণ্টন না হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত এই বৈষম্য বাড়ছে। এখন প্রয়োজন শুধু উন্নয়ন নয়, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কারিগরি প্রশিক্ষণে সবাইকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা না হলে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুফল আমরা পাব না।’
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈষম্য কমানোর জন্য এখন প্রয়োজন কৌশলী কর্মসূচি নেওয়া। এই কর্মসূচিতে সবাইকে সমান অগ্রাধিকার দিতে হবে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এই কর্মসূচি নিতে হবে।