Hot

আন্দোলনে আহতদের হাহাকার, এখন ফ্রি চিকিৎসা মিলছে, এতদিনে নিঃস্ব অনেকে

বৈমষ্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন অনেকে। নতুন সরকারের ঘোষণার পর বর্তমানে হাসপাতালের পক্ষ থেকে ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থা করা হলেও এতদিনে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেকের পরিবার। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে যতদিন আছি চিকিৎসা বিনামূল্যে পেলেও বাড়ি ফেরার পর দীর্ঘদিন ধরে চলা এই চিকিৎসা ব্যয় কীভাবে জোগাড় করবো তাই নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়। 

গতকাল সরজমিন রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালটির নিচতলার ক্যাজুয়ালিটি-২ এর ৫৬টি বেডের সব কয়েকটিতেই ছাত্র  আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৫৬ জন রোগী। গুলির আঘাতে ছিন্নভিন্ন হওয়ায় এদের কারোর পা কেটে ফেলা হয়েছে। কারোর আবার পায়ে লোহার রড লাগানো হয়েছে। কারোর আবার গুলি লেগে হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। এমনই একজন মেহেদী আলম। গত ১৮ই জুলাই গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড থেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত একমাস ধরে পঙ্গুর ক্যাজুয়ালিটি-২ এর জি-০১ নম্বর বেডে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাবা মারা যাওয়ার পর চার বোন দুই ভায়ের সংসারের হাল ধরতে শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় আসেন মেহেদী। গুলশান-১ নম্বর এলাকায় একটি ফুলের দোকানে কাজ করতেন তিনি।

কাজ শেষ করে রাত আটটার পর মধ্য বাড্ডার বাসায় ফিরছিলেন। এরমধ্যেই গুলিবিদ্ধ হন মেহেদী। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সেখান থেকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেলে। ঢাকা মেডিকেল থেকে ওই রাতেই আনা হয় পঙ্গুতে। মেহেদীর বড় বোন ডালিয়া বলেন, এখন পর্যন্ত আমার ভায়ের ৭টা অপারেশন করা হয়েছে। আরও কয়টা করা লাগবে তার ঠিক নেই। এ পর্যন্ত হাসাপাতালে চিকিৎসা, থাকা-খাওয়া দিয়ে প্রায় ৭০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়ে গেছে। বর্তমানে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ওর পায়ের হাড় গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেছে। নার্ভ (শিরা) ছিড়ে গেছে। সুস্থ হতে অনেক সময় লাগবে। তাই বাড়িতে ফেরার পর কীভাবে সেই টাকা জোগাড় করবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। 

গত ১৮ই জুলাই মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে একই ওয়ার্ডের জি-৬ নম্বর বেডে চিকিৎসা নিচ্ছেন পল্লবী মাজেদুল ইসলাম মডেল হাই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র মো. সিফাত। তারও গুলি লেগে ডান পায়ের হাঁটুর জয়েন্টের হাড় ভেঙে যায়। সিফাত বলেন, ওইদিন আমি সন্ধ্যার পর মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায় অবস্থান করছিলাম। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ একদল পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে সামনে এগুতে থাকে। এ সময় আমরা সকলে ভয়ে দৌড়ানো শুরু করি। আমি দৌড়ে প্রায় ৫০/৬০ জনকে অতিক্রম করে চলে আসি। এরপর হঠাৎ আমার পায়ে গুলি লাগলে আমি পড়ে যাই। ওই সময় আমার বন্ধুরা আমাকে উদ্ধার করে আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে এখানে পাঠানো হয়। সিফাতের মা বলেন, আমার ছেলের হাঁটুর জয়েন্টের হাড় ভেঙে গেছে। গত একমাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি। সুস্থ হতে আরও কয়দিন লাগবে তা জানা নেই। প্রতিদিন বাসায় যাওয়া, আসা, খাবার খাওয়া, চিকিৎসা ব্যয় দিয়ে  হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমাদের ৭৫ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়ে গেছে। এখন হাসপাতালের পক্ষ থেকে চিকিৎসাসহ টেস্ট, ওষুধ ফ্রী দেয়া হচ্ছে। কিন্তু খরচ যা, তা আগেই হয়ে গেছে। খাওয়া-দাওয়া, যাওয়া-আসা  তো আছেই। এরপর হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার পর কতো কী লাগবে তা আল্লাহ জানে। সিফাতের বেডের পাশেই জি-৭ নম্বর বেডে মাসখানিক ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেলিভারিম্যান শিমুল আহমেদ। গত ১৯শে জুলাই তিনিও গুলিবিদ্ধ হন মিরপুর-১০ নম্বর এলাকায়। তার গুলি লাগে ডান পায়ের উরুতে। শিমুল বলেন, আমার বাড়ি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে। আমি ঢাকায় দোকানে দোকানে মাল ডেলিভারি দিই। সেদিন আমার কাজ বন্ধ থাকায় আন্দোলনে যোগ দিই। সন্ধ্যার দিকে হঠাৎ আন্দোলনকারীদের ওপর মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকা থেকে গুলি করছিল পুলিশ। গুলির শব্দ শুনে আমি ও আমার বন্ধুরা মিরপুর ১১’র দিকে দৌড়ানো শুরু করি। এর মধ্যে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন পার করতেই গলির মধ্য থেকে কে বা কারা গুলি ছোড়ে। সেই গুলি লেগে আমার পা রক্তাক্ত হয়। বন্ধুরা তখন আমাকে উদ্ধার করে আলোক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে এখানে পাঠানো হয়। প্রথম দুই-তিন দিনেই আমার ৫৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখন বাসায় ফেরার পর তো সহজে কোনো কাজে যোগ দিতে পারবো না। তাই নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। 

গত ১৮ই জুলাই উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে কাজ শেষ করে মালিকের বাসায় গাড়ি রেখে বের হচ্ছিলেন প্রাইভেটকার চালক মো. আরাফাত হোসেন। বাসা থেকে বের হওয়ার কিছু দূর যাওয়ার পরই পুলিশের ছোড়া গুলি তার বাম পায়ে হাঁটুর নিচের হাড় ভেদ করে চলে যায়। শিরা ছিড়ে যায়। হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয় তার পা। এক পা হারিয়ে এখনো পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ ওয়ার্ডের জি-৩৮ নাম্বার বেডে কাতরাচ্ছেন আরাফাত। তিনি বলেন, বর্তমানে হাসপাতালের পক্ষ থেকেই সব চিকিৎসা, টেস্ট, ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এর আগেই ধারদেনা করে প্রায় ৮০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়ে গেছে। হাসপাতালে থাকাকালীন তো চিকিৎসা নিয়ে চিন্তা নেই। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বাকি জীবনটা বৌ-বাচ্চা নিয়ে কী করবো তাই ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না। তিনি বলেন, আমার পা নেই। ৭ বছরের বাচ্চাটার ভবিষ্যৎ কী হবে তাও ভাবতে পারছি না। আপাতত গ্রামের বাড়ি পাবনাতে চলে যাবো। তারপর কী করবো জানি না। 

আরাফাতের পাশের বেড জি-৩৭ এ চিকিৎসা নিচ্ছেন তিতুমীর কলেজের ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী সালমান হোসেন। ১৯শে জুলাই দুপুর আড়াইটার দিকে রামপুরা এলাকায় তারও বাম পায়ে গুলি লাগে। তিনি বলেন, আমরা সেদিন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে অবস্থান নিই। পুলিশের সঙ্গে আমাদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলছিল। আমরাও সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, পুলিশও গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছিল। এরই একপর্যায়ে রামপুরার কাছে আমার পায়ে গুলি লেগে বের হয়ে যায়। সেখান থেকে আমাকে ধরাধরি করে সকলে স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে ওইদিন রাতেই পঙ্গুতে আনা হয়। প্রথমে কয়দিন হাসপাতালে এসেও ভয়ে ছিলাম। এখন স্বাভাবিক। সালমানের মা বলেন, ফোন বন্ধ করে আন্দোলনে চলে যেত। বাসায় ফিরে আবার ফোন দিয়ে বলতো সব ঠিক আছে। এরই মধ্যে ওর পায়ে গুলি লাগে। এখন ওর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা দুশ্চিন্তায় আছি। 

পরিবারের হাল ধরতে ববগুনার বেতাগী উপজেলায় পড়ালেখা করলেও গত মাসে ঢাকায় আসেন ডিগ্রি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী মামুন। কাজ নেন বিস্ট্র রেস্টুরেন্টে। ১২ দিন কাজের মাথায় গত ১৯শে জুলাই রামপুরা এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। সেদিন থেকেই ভর্তি রয়েছেন পঙ্গু হাসপাতালের ক্যাজুয়ালিটি-২ এর জি-১৩ নম্বর বেডে। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত লাখ টাকার উপরে খরচ হয়ে গেছে। বর্তমানে ফ্রি চিকিৎসা পেলেও বাড়িতে ফিরে কী করবো, কী খাবো, কীভাবে সংসার চালাবো তাই নিয়ে আছি দুশ্চিন্তাই। বাবা বৃদ্ধ হয়েছে। তেমন কিছুই করে না। বড় ভাইয়ের মাথায় সমস্যা। আর আমি যে কবে সুস্থ হবো তার ঠিক নেই। আমাদের পরিবারটা ভেসে যাবে।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)’র পরিচালক অধ্যাপক কাজী শামীম উজ্জামান বলেন, আমাদের এখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের সকলের খরচ আমরা বহন করছি। আমাদের এখানে বর্তমানে ১৪৪ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ, অপারেশন সব আমরা বিনামূল্যে দিচ্ছি। যারা গুরুত্বর আহত তাদেরকে আমার ভর্তি করে চিকিৎসা দিচ্ছি। আমরা এসব রোগীদের জন্য ডেডিকেটেড একটা ওয়ার্ড করেছি। 

উল্লেখ্য, এ ছাড়াও রাজধানীর ছয়টি সরকারি হাসপাতালে এ রকম ৪৩৯ রোগীর চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে

 ঢাকা মেডিকেলে ১৭৫ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪১ জন, চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ৩২ জন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ৩০ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ জন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে ১২ জন আছেন। এর বাইরে বেশকিছু আহত ব্যক্তি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d