Hot

আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর গুলি : অবৈধ অস্ত্রধারীরা অধরা, আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতির আশংকা

মাথায় হেলমেট আর গলায় গামছা বেঁধে শটগান, পিস্তল, রিভলভার এমনকি একে-৪৭য়ের মত ভয়ংকর অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি ছুড়ার সাথে জড়িতদের শনাক্ত করা বা গ্রেফতারে কোন উদ্যোগ নেই আইন-শৃংখলা বাহিনীর। এই সুযোগে অনেকেই নানা কায়দায় দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন বা পালানোর চেষ্টা করছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডারদের ছাত্র-জনতার উপর গুলি করতে দেখা গেছে। পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসারের যে সব সদস্যরা ছাত্রদের উপর গুলি করেছে তার বাইরে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে শত শত ছাত্র-জনতা প্রান হারিয়েছেন। যার ভিডিও ও স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা দেশে অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে এটা উদ্বেগজনক। পুলিশের প্রথমেই এই অস্ত্র হেফাজতে নিতে হবে। না হলে বড় বিপদ হতে পারে। যুবলীগ-ছাত্রলীগের ক্যাডারদের ব্যবহ্নত এসব আগ্নেয়াস্ত্র এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ফলে হত্যাসহ বড় ধরনের অপরাধ করার সুযোগ রয়েছেন এদের। দ্রুত এদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হলে দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটার আশংকা রয়েছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের বাইরে সাদা পোষাকে ছাত্রদের উপর গুলির ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করছে গোয়েন্দারা। খুব শীঘ্্রই তালিকা করে গ্রেফতার অভিযান চালানো হবে। চট্টগ্রামের একটি ছবিতে দেখা যায়, মাথায় হেলমেট, গলায় গামছা মোড়ানো, গায়ে একটি কালো টি-শার্ট ও নীল রঙের থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরা এক যুবক একে-৪৭-এর মতো অস্ত্র হাতে ছাত্রদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। ওই অস্ত্রধারীর নাম মোহাম্মদ সোলাইমান ওরফে সোলাইমান বাদশা। সোলাইমান ১৩ নং পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ওয়াসিমের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে পরিচিত। তার বিরুদ্ধে ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও ডাকাতির বেশ কয়েকটি মামলাও আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীসহ সারাদেশে সাদা পোশাকে যারা ছাত্রদের উপর গুলি চালিয়েছে তাদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। এসব অস্ত্রধারীরা একে-৪৭ রাইফেলের মতো ভয়ংকর অস্ত্রও ব্যবহার করেছে। এটি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র। বিশ্বের প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশেষায়িত এই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বেসামরিক বাহিনীতে এই অস্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে। সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশের বিশেষায়িত বাহিনী ছাড়া আর কারও কাছে এই অস্ত্র থাকার কথা না। এসব অস্ত্র কোথায় থেকে এসেছে তাও তদন্ত হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ১৮ জুলাই দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বহদ্দারহাট মোড়ে চলা সংঘর্ষে ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন চার অস্ত্রধারী। হামলাকারীরা সরকারদলীয় স্লোগান দিয়েছেন। কালো টি-শার্ট ও নীল জার্সি পরা দুজনকে একটি শটগান দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে। বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে একটি গ্রুপ থেকে ওই দুজন গুলি ছোড়েন। আরও দুজন রিভলবার দিয়ে গুলি করেন। এদিন তাদের ছোড়া গুলিতে দুইজন নিহত ও অন্তত ৫০ জন আহত হন।

গত ৪ আগস্ট সাভার বাসস্ট্যান্ড ও রেডিও কলোনি এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর মেশিনগান দিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন সাভার উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক। একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, আতিক তার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্রের ট্রিগার টানছেন আর সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। ১৯ জুলাই সাভার থানা স্ট্যান্ডে সংঘর্ষেও তার হাতে পিস্তল দেখা যায়। সেদিনও শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান এই আতিক। ৪ আগস্টের আরেকটি ভিডিওতে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রাজু আহমেদকে বিদেশি অস্ত্র দিয়ে গুলি চালাতে দেখা যায়। এদিন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালান উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মেহেদি হাসান তুষার, সাইদুর রহমান সুজন, দেওয়ান মাসুম, সাভার উপজেলা চেয়ারম্যানের শ্যালক মাজহারুল ইসলাম রুবেল। এ ছাড়া ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জ শহরের ডিআইটি গেট এলাকায় ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন নারায়ণগঞ্জ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও তার ছেলে আয়ান ওসমান। এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায় প্রায় ঘণ্টা ধরে তারা ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকেন। এ সময় তাদের সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ জন সশস্ত্র যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছিলেন। প্রত্যেকের হাতে দেশি-বিদেশি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। গত ৪ আগস্ট মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ছোড়েন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হোসেন খান নিখিল ও মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি। ওই সময় ঢাকা উত্তরের প্রায় দেড় শতাধিক নেতাকর্মীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়। তারা বার বার ছাত্রদের ধাওয়া করে গুলি ছোড়েন। এতে শত শত শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হন। এদিন মিরপুর ১০ নম্বরে গুলিতে ৫ শিক্ষার্থী মারা যান। ৪ আগস্ট ঢাকার মোহম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকার কালভার্ট ফুট ওভারব্রিজের নিচে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘর্ষ হয়। শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। মোহাম্মপুর ৩৩নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ, সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজিব ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের পিএস মাসুদুর রহমান বিপ্লবের হাতে শটগান, একে-৪৭ ও চাইনিজ রাইফেল দেখা যায়। সেদিন তাদের সঙ্গে থাকা শতাধিক নেতাকর্মীর সবার হাতেই বিভিন্ন প্রকার আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। ৪ ঘণ্টা ধরে চলা সংঘর্ষে গুলিতে এক শিশুসহ ৩ জন নিহত হয়। গুলিবিদ্ধ হয় অন্তত ১৪৭ জন। তাদের সিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। ৪ আগস্ট বিকালে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালান ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পি। তখন তার সঙ্গে আরও ১০ থেকে ১২ জনকে ছাত্রদের ধাওয়া করে গুলি চালাতে দেখা গেছে। ২ আগস্ট উত্তরা ১১নং সেক্টরে শিক্ষার্থীদের মিছিলে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় শটগান হাতে গুলি ছুড়তে দেখা যায় তুরাগ থানা যুবলীগ নেতা নাজমুল হাসানকে। ওই সময় যুবলীগ নেতাদের প্রত্যেকের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে। সেদিন গুলিতে ৬ শিক্ষার্থী আহত হয়। ৪ আগস্ট মানিকগঞ্জ সদরের খালপাড়ে ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন জেলা ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এ সময় এসএমজি হাতে কার্লেস শুভ, শটগান হাতে সানি আহমেদ, পিস্তল হাতে যুবলীগ নেতা বাশারকে দেখা যায়। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আরও ছিলেন অভিজিৎ সরকার, রুবেল হোসেন ও রেয়াদ খান। তারা দফায় দফায় শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে গুলি চালান। গুলিতে ১ শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। গুলিবিদ্ধ হয় আরও শতাধিক।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button