আমাদের মস্তিষ্ক ‘চোখের পলকে’ লিখিত বাক্য দেখে বুঝতে পারে: গবেষণা
গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন এই আবিষ্কার, আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে ভাষা এনকোড করে সে সম্পর্কে মূল সূত্র উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
নতুন গবেষণায় জানা গেছে, মানুষের মস্তিষ্ক এক নজর দেখেই লিখিত ভাষার মৌলিক কাঠামোগুলো শনাক্ত করতে পারে। এই সক্ষমতার কারণে আমরা স্মার্টফোনের মাধ্যমে পাওয়া বিপুল তথ্যের সম্ভার দ্রুত পড়তে পারি।
এই গবেষণায় ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবকের মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মানুষ ১২৫ মিলিসেকেন্ডেরও কম সময়ে বা চোখের পলক ফেলার সময় টুকুর মধ্যেই মৌলিক বাক্য কাঠামো শনাক্ত করতে পারে।
এর অর্থ, মানুষ চোখের সামনে দেখা দৃশ্য উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে, শব্দও অনুধাবন করতে পারে। এই দক্ষতার মাধ্যমেই মানুষ তার চারপাশের বিশ্বকে ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ এবং চিনতে পারে।
গত বুধবার (২৩ অক্টোবর) সায়েন্স অ্যাডভান্সেস জার্নালে প্রকাশিত নতুন এই আবিষ্কার, আমাদের মস্তিষ্ক কীভাবে ভাষা এনকোড করে সে সম্পর্কে মূল সূত্র উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব ও মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক লিনা পাইলকানেন লাইভ সায়েন্সকে বলেন, ‘মস্তিষ্ক কীভাবে লিখিত বার্তা প্রক্রিয়া করে তা পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানীরা ভাষার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারেন।’
পাইলকানেন বলেন, মুখের কথার দ্বারা ভাষার নিউরোবায়োলজি অধ্যয়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।
এই সমস্যা এড়াতে গবেষকরা ‘ম্যাগনেটোয়েন্সফালোগ্রাফি’- নামে একটি কৌশল ব্যবহার করেছিলেন। এই পদ্ধতিতে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়াকলাপ শনাক্ত করতে চৌম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করা হয়।
স্ক্যান করার সময় স্বেচ্ছাসেবীদের একটি স্ক্রিনে ৩০০ মিলিসেকেন্ডের জন্য একটি তিন শব্দের বাক্য দেখানো হয়, তারপরেই আবার দ্বিতীয় বাক্য দেখানো হয়। দ্বিতীয় বাক্যে হয় আগের বাক্যের চেয়ে একটি শব্দ বদলে দেওয়া হয় বা আগের বাক্যকে অবিকৃত রাখা হয়।
অংশগ্রহণকারীদের কাজ ছিল দ্বিতীয় ও প্রথম বাক্য একই ছিল কি না, নাকি কোনো পরিবর্তন করা হয়েছিল তা শনাক্ত করা।
এই পরীক্ষায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের বাম টেম্পোরাল কর্টেক্স – ভাষা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গটির বাইরের স্তরের অংশ — অবিন্যস্ত শব্দ তালিকার তুলনায়, তিনশব্দের বাক্য শনাক্তে বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এবং মাত্র ১২৫ মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই এই প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অংশগ্রহণকারীরা সে বাক্যগুলোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো পারফর্ম করেছেন, যেগুলোতে একটি সাবজেক্ট, ভার্ব ও অবজেক্ট ছিল। এছাড়া ‘হৃদয়, ফুসফুস, যকৃৎ’- এর মতো বিশেষ্যের তালিকার তুলনায়, ‘নার্স ক্ষত পরিষ্কার করেন’-এর মতো বাক্যের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
অ্যাগ্রিমেন্ট [বাক্যের ভার্ব ও সাবজেক্ট সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়া] ঠিক না থাকা বাক্যের ক্ষেত্রেও এই দ্রুত শনাক্তকরণের বিষয়টি দেখা যায়। যেমন- ‘নার্সরা ক্ষত পরিষ্কার করেন’-এই বাক্যের অ্যাগ্রিমেন্ট ভুল থাকার বিষয়টিও একই রকম সময়ের মধ্যেই মস্তিস্ক শনাক্ত করতে পারছে।
দেখা যায়, অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্ক ‘ক্ষত পরিষ্কার নার্স’- এর মতো এলামেলো বাক্যও একই গতিতে শনাক্ত করেছিল।
গবেষকরা বলেন, এতে বোঝা যায় আমাদের মস্তিষ্ক শুধু শব্দের উপস্থিতি শনাক্ত করছে না, বরং বাক্যগুলোর অর্থ কী তা আরও ভালভাবে বিশ্লেষণ করতে আমাদের পূর্ববর্তী জ্ঞান প্রয়োগ করছে।
পাইলকানেন বলেন, ‘কিছু ভাষা কাঠামো অন্যগুলোর তুলনায় দ্রুত শনাক্ত করা যায় এবং তারপর মস্তিষ্কেই দ্রুত বাক্যটি সঠিকভাবে গঠিত হতেও পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি দারুণ। কারণ [বাক্য] কাঠামোগত জ্ঞান বিমূর্ত, তবে উদ্দীপনা থেকেও এটি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন।’
মস্তিষ্ক দ্রুত শনাক্ত করতে পারে এমন বাক্য কাঠামোর ধরনগুলো নিয়ে আরও অধ্যয়ন করছেন গবেষকরা।
তারা তাদের পাওয়া ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে আরও অনুসন্ধান চালানোর পরিকল্পনা করছেন, যাতে মস্তিষ্ক যেগুলো দ্রুত শনাক্ত করতে পারে সেসব বাক্যের গঠনগুলো নির্ণয় করতে পারেন।
এছাড়া, শৈশবে মানুষ প্রথম যে ধরনের বাক্য শেখে, তার সঙ্গে এই দ্রুত শনাক্ত করার বিষয়টির কোনো সম্পর্ক আছে কি না তাও খতিয়ে দেখার পরিকল্পনা করেছেন গবেষকরা।
তারা এছাড়াও পরীক্ষা করতে চান; অন্যান্য ভিজ্যুয়াল উদ্দীপনা যেমন ছবি, চিহ্ন বা অন্যান্য যে প্রক্রিয়াগুলো মানুষ ব্যবহার করে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও মস্তিস্কে একই প্রতিক্রিয়া হয় কি না।