USA

আমেরিকাতে এখনও কেন নারী প্রেসিডেন্ট নেই

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় লিঙ্গ পরিচয় ও তার রাজনীতি নিয়ে অধ্যয়ন করেন– এমন ছয় গবেষকের সাথে এবিষয়ে আলাপ করেছেন দ্য আটলান্টিকের লেখক ওলগা খাজান। তাঁরা মনে করেন, লিঙ্গ পরিচয় এক্ষেত্রে সামান্য একটি বিষয় হলেও – তা হ্যারিসের পরাজয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এটি ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া অন্য নারীদের জন্যও সমস্যার সৃষ্টি করবে।  

সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিনেটর হিলারি ক্লিনটন যখন ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন, তখন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে নবীন ও অনভিজ্ঞ ধনাঢ্য আবাসন ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবুও তাঁকে হারতে হয়। তখন বেশিরভাগ ভোটারের মনোভাব এমন ছিল যে, নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভোট দেওয়া যায় অবশ্যই – তবে এই নারীকে নয়।

২০২৪ সালে ডেমোক্রেটদের হয়ে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়েন বাইডেন প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। এবারে তাঁরও প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলের ডোনাল্ড ট্রাম্প। না ব্যালটে মোটেও সুবিধা করতে পারেননি সাবেক এই অ্যাটর্নি জেনারেল ও সিনেটর। এমনকী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগে মামলা থাকার পরেও শেষ হাসি তিনিই হেসেছেন। হিলারির পরে হেরেছেন প্রথম নারী হিসেবে প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া কমলা হ্যারিস-ও। 

এবারও ভোটারদের মনোভাব ছিল – নারীদের ভোট দেওয়াই যায়, তবে এই নারীকে নয়। 

তাই আমেরিকার গত আট বছরের নির্বাচনের ফলাফলকে সামনে রেখে এই প্রশ্নই জাগে— যদি হিলারি ক্লিনটন বা কমলা হ্যারিসও ভোটারদের কাছে উপযুক্ত না হন, তবে কি আদৌ কোনদিন দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য কোনো নারীকে জনগণ যোগ্য ভেবে নির্বাচিত করবে? করলে- কী ধরনের নারী হতে হবে তাঁকে? 

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থায় লিঙ্গ পরিচয় ও তার রাজনীতি নিয়ে অধ্যয়ন করেন– এমন ছয় গবেষকের সাথে এবিষয়ে আলাপ করেছেন দ্য আটলান্টিকের লেখক ওলগা খাজান। তাঁরা মনে করেন, লিঙ্গ পরিচয়ের বিষয় সামান্য একটি বিষয় হলেও – তা হ্যারিসের পরাজয়ের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর এই বিষয়টি ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া অন্য নারীদের জন্যও সমস্যার সৃষ্টি করবে।  

এমন একজন গবেষক ও কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির কমিউনিকেশন্সের অধ্যাপক কারিন ভেসবি অ্যান্ডারসনের মতে, ‘আমেরিকান ভোটারদের মধ্যে একটা সার্বিক ধারণা যে তাঁরা নারী (প্রেসিডেন্ট) প্রার্থীর বিষয়টি সমর্থন করেন। কিন্তু, সত্যিই যখন কোনো নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে তাঁদের সামনে আসেন, তখন তাঁরা ওই প্রার্থীকে অপছন্দ হওয়ার মতো কোনো না কোনো খুঁত বের করেন।’

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে নারীরা যেসব বাধার সম্মুখীন হন তা নিয়ে একটি দীর্ঘ গবেষণামূলক নিবন্ধ লিখেছিলেন কারিন। 

ওলগা খাজানকে দেওয়া সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, হ্যারিসকে হারাতে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বৈরিতাই একমাত্র কারণ তা বলা যাবে না। এখানে অন্যান্য বিষয়ও কাজ করেছে। এই নির্বাচনে ভোটারদের কাছে একটা বড় বিষয় ছিল অর্থনীতি।

সার্বিকভাবে মার্কিন অর্থনীতি অন্যান্য উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশ শক্তিশালী অবস্থানে থাকলেও – মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহারের মতো বিষয়গুলো ডেমোক্রেট সরকারের প্রতি ভোটারদের মধ্যে বিরাগ তৈরি করে। হ্যারিস যেহেতু বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট, সুতরাং এ দায় তাঁর ওপরও বর্তায়। তাছাড়া, নির্বাচনি প্রস্তুতি মাঝপথে ব্যাহত হয় ডেমোক্রেট শিবিরের। গত জুলাইয়ে যখন দ্বিতীয় মেয়াদের প্রার্থিতা থেকে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে সরে দাঁড়াতে হয়– তখন নতুন প্রার্থী হিসেবে প্রচারণা কাজের জন্য মাত্র চার মাস সময় পান হ্যারিস। এই অল্প সময়ের মধ্যেই নতুন প্রচার কৌশল ও আমেরিকান ভোটারদের কাছে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে হয় তাঁকে। যা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অবশ্যই। প্রতি নির্বাচনেই খুব অল্প সংখ্যক ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেন, ফলে একজন বাদে অন্যদের হারতেই হয়– এটাই গণতন্ত্র।    

কিছু লোক বরাবরাই কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বিরোধী। ২০১৭ সালের এক জরিপে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নারীর দায়িত্ব পালনের বিষয়ে ‘ক্ষোভ বা হতাশা’ ব্যক্ত করেন ১৩ শতাংশ আমেরিকান। একইবছরে আরেকটি তাত্ত্বিক গবেষণা করেন উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী – ইওশিকুনি ওনো এবং ব্যারি বার্ডেন। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট পদ দাঁড়ানো নারী প্রার্থীকে ভোট দেন না অন্তত ২.৪৭ শতাংশ ভোটার। অর্থাৎ, পুরুষ হলে যদি তিনি ৪৯.৪ শতাংশ ভোট পেতেন, নারী হওয়ায় সেখানে পান মাত্র ৪৭ শতাংশ।   

ওনো ও বার্ডেন দেখিয়েছেন, নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রতি এ ধরনের বৈষম্যমূলক মনোভাব সবচেয়ে বেশি পুরুষ এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অসম্পৃক্ত এমন ভোটারদের মধ্যে। আর এ দুই জনগোষ্ঠীর সমর্থ পেতে এবারের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকেও হিমশিম খেতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো দলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে নিবন্ধন করাতে পারেন ভোটাররা, যারা এটি করেন না তাঁদেরকে বলা হয় স্বতন্ত্র ভোটার। এরা কোনো দলের প্রতিই সেভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হওয়ায়— নির্বাচনি প্রচারণায় প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য ম্যান্ডেট দেখেশুনে ভোট দেন। এক্ষেত্রেও হ্যারিস হালে পানি পাননি। 

তবে নারীর প্রতি বৈষম্যের যে ব্যাখ্যা, তার বিপরীত যুক্তিও আছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক শীর্ষপদে অনেক নারীই নির্বাচিত হয়েছেন ও হচ্ছেন। কেবল প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি কেউ। যেমন মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ (কংগ্রেস) এর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্যই হলেন নারী। নারী গভর্নর-ও রয়েছেন ১২ জন।  

অবশ্য অন্যান্য রাজনৈতিক পদে নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি আলাদাও হতে পারে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বেলায় যা হয়তো আরও আলাদা। গবেষকরা ভোটারদের প্রতি প্রশ্ন রেখেছিলেন – পুরুষতান্ত্রিক নাকি নারীবাদী – প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কোন ধরনের বৈশিষ্ট্যকে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। সেখানে সমব্যথী হওয়ার গুণকে নারীবাদী বৈশিষ্ট্য এবং পুরুষতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে শক্তি প্রদর্শনের মতো বিশেষ কিছু দিক উল্লেখ করা হয়। 

লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক-গণসংযোগ বিষয়ের অধ্যাপক নিকোল বাওয়ের বলেন, “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদের সর্বোচ্চ সম্মান ও প্রতিপত্তির কথা চিন্তা করেই অনেকে মনে করেন এ দায়িত্ব একজন নারীকে দেওয়া অনেক বেশি ঝুঁকির।” তিনি ব্যাখ্যা করেন, এজন্য আজো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে পুরুষতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে প্রার্থীরা তাঁদের প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে নারীসুলভ চরিত্রের বলে খাটো করার প্রয়াস চালান প্রায়ই। যেমন ২০০৪ সালে প্রতিদ্বন্দ্বী জন কেরিকে শীর্ণকায় বলে উল্লেখ করেছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশ। আবার মার্কো রুবিওকে হাই হিলের জুতা পরার জন্য বিদ্রূপ করেছিলেন তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীরা। তাছাড়া, যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র রয়েছে যেমন যুক্তরাজ্য ও জার্মানি – সেখানেই নারী সরকারপ্রধান দেখা যায়, কারণ নির্বাচিত রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের বেছে নেয়। 

এদিকে যেসব নারীর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তাঁদেরকেও নারীসুলভ না হওয়ার কারণে ভোটদানে নিরুৎসাহ দেখা যায়। অক্সিডেন্টাল কলেজের জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ক্যারোলিন হেল্ডম্যান বলেন, “কোনো নারীকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে হলে, তাঁকে অবশ্যই অতি-পুরুষতান্ত্রিক হতে হবে; কিন্তু যখনই তিনি সেরকম করতে যান– তখনই (আমেরিকান) জনগণের একটি বড় অংশ নারীসুলভ আচরণ না করায় তাঁর নিন্দা জানাতে শুরু করে।”

তিনি আরও বলেন, সারাহ পেলিন ও হিলারি ক্লিনটন দুজন দুইভাবে চেষ্টা করেছিলেন এই বিভেগ ভাঙতে। কিন্তু, কারোরই লাভ হয়নি, দুজনকেই শেষপর্যন্ত লিঙ্গবৈষম্যের দৃষ্টিভঙ্গির কাছে হার মানতে হয়েছিল।

তাহলে কংগ্রেসে এত নারী কীভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। উত্তর হলো- এককভাবে তাঁরা কেউই ব্যাপক ক্ষমতাধর নন, প্রতিনিধি পরিষদের আইনপ্রণেতাদের জনগণের সেবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রেসিডেন্টের মতো ‘বগ বসের’ তুলনায় তাঁদেরকে মাঝারি স্তরের ব্যবস্থাপক হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে নারী গভর্নরও রয়েছেন, যাদের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা রয়েছে। তবে তাঁরা রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করেন না। ফলে সম্পূর্ণ ক্ষমতাধর তাঁরাও নন এবং একারণেই প্রেসিডেন্টের পরিবারের মতো তাঁদের পরিবারকে আদর্শ পরিবারের মানদণ্ডে জাতীয়ভাবে দেখা হয় না। 

অ্যান্ডারসন বলেন, এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখবেন, নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়ে আপনি কেবল প্রেসিডেন্ট কেমন হওয়া উচিৎ– সে ধারণাকেই চ্যালেঞ্জ করছেন না; একইসঙ্গে লিঙ্গ সম্পর্কে যেসব প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে– সেগুলোর বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন।

ওনো ও বার্ডেন তাঁদের গবেষণায় তুলে ধরেন যে, কংগ্রস বা সিনেটের জন্য প্রার্থী হলে কোনো নারী ভোটার অসন্তোষের ততোটা শিকার হন না, যতোটা তাঁরা হন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হলে। বার্ডেনের ধারণা এর পেছনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও কাজ করছে। যেহেতু আমেরিকায় আজ পর্যন্ত কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হননি– তাই একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে কল্পনা করতেও পারেন না ভোটাররা। 

অর্থাৎ, কখনো নারী প্রেসিডেন্ট ছিলেন না বলেই– অন্য নারীরা প্রেসিডেন্ট হতে পারছেন না, এমন এক আজব পাকচক্র তৈরি হয়েছে। ওলগা খাজান একাধিক গবেষকের সাক্ষাৎকার নেন এবিষয়ে, যাদের কেউই মনে করেন না যে অচিরেই কোনো নারী প্রেসিডেন্ট হতেও পারবেন। হেল্ডম্যান বলেন, কোনো নারীকে হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত হতে দেখলে আমার দারুণ লাগতো, কিন্তু অন্তত আমার জীবদ্দশায় তেমনটা ঘটবে না বলে মনে করি। তাছাড়া, কমলা ও হিলারির পরাজয়ের পরে– কোনো দলই আর সহজে নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী দেবে না বলেই মনে হয়। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button