Hot

আয়নাঘরের রূপকার ২২ কর্মকর্তা: পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের

গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে হাসিনা সরকারের প্রতাপশালী প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই) ও র‌্যাবে নিযুক্ত ছিলেন এমন কর্মকর্তাদের নাম রয়েছে। যাদের বেশির ভাগ আলোচিত ‘আয়নাঘর’-এর রূপকার হিসাবে চিহ্নিত। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে ইমিগ্রেশনেও জরুরি বার্তা পাঠাতে বলা হয়। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠিতে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের উপসচিব কামরুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে ২২ জন কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ১৮ নভেম্বর পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির অনুরোধ অনুযায়ী কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে গুমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ পাওয়া যায়। তদন্তের প্রয়োজনে বর্ণিত ব্যক্তিরা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সে লক্ষ্যে তাদের পাসপোর্ট বাতিলসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকার বেশির ভাগ কর্মকর্তা হাসিনা সরকারের সময় সামরিক বাহিনীতে প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। কয়েকজন ছিলেন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই) এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) প্রধান। বাকিরা চাকরিজীবনে গোয়েন্দা সংস্থা এবং র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যটালিয়নের (র‌্যাব) বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

তালিকা : পাসপোর্ট বাতিলের জন্য পাঠানো তালিকার এক নম্বরে রয়েছে লে. জেনারেল (অব.) মোল্লা ফজলে আকবরের নাম। তিনি হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদে ২০০৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের ২২ জুন পর্যন্ত যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। এছাড়া তালিকাভুক্ত লে. জেনারেল আকবর হোসেন, সাইফুল আবেদীন, সাইফুল আলম, আহমেদ তাবরেজ শামশ চৌধুরি, মেজর জেনারেল হামিদুল হক বিভিন্ন সময়ে ডিজিএফআই ও এনএসআই-এর শীর্ষ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বিরুদ্ধে আলোচিত আয়নাঘর সৃষ্টি, গুম এবং ক্রসফায়ারে রাজনৈতিক বিরোধী দমনসহ গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

তালিকায় মেজর জেনারেল শেখ মামুন খালেদ, মেজর জেনারেল সুলতাউজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন, মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, মেজর জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সারোয়ার হোসেইন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তানভির গনি চৌধুরি, কর্নেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাবেরী খান, সাবেক র‌্যাব কর্মকর্তা কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন, লে. কর্নেল কিসমত হায়াৎ, লে. কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ, লে. কর্নেল মেহেদী হাসান, মেজর রাহাত উস সাত্তার, ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়া উর রহমান এবং ওয়ারেন্ট অফিসার ইমরুল কায়েসের নাম রয়েছে। 

এছাড়া ইতোমধ্যে গ্রেফতার হয়ে কারাবন্দি সাবেক পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিনের পাসপোর্টও বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দুজনেই চাকরিজীবনের একটি বড় সময় র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে সংযুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে আলেপ উদ্দিন র‌্যাব-১১তে কর্মরত থাকাকালে তার বিরুদ্ধে গুম ও ক্রসফায়ারের একাধিক অভিযোগ ওঠে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গুম কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, বর্ণিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ৯ জন ডিজিএফআই-এর অভ্যন্তরে অবস্থিত বিশেষ যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেল বা জেআইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। আওয়ামী লীগ শাসনামলের বিভিন্ন সময় তারা সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ডিজিএফআই-এর সাবেক প্রধান লে. জেনারেল সাইফুল আলম, লে. জেনারেল আহমেদ তাবরেজ শামস চৌধুরি এবং মেজর জেনারেল হামিদুল হককে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। 

চিঠিতে আরও বলা হয়, ডিজিএফআই-এর অভ্যন্তরে সিটিআইবি নামক শাখায় দায়িত্ব পালনকারী ৭ জন কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। যারা বিভিন্ন সময় র‌্যাবে সংযুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে লে. জেনারেল এসএম মতিউর রহমান ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি), কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার উপপরিচালক, র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক এবং এডিজি ছিলেন। এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহ উদ্দিন ছিলেন সিটিআইবির কর্নেল জিএস। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানতে পেরেছে গুম কমিশন। এর বাইরে পাসপোর্ট বাতিলের তালিকায় থাকা কর্নেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান সাবেরী খান ডিজিএফআই সদর দপ্তরের মেডিকেল অফিসার ছিলেন। 

পাসপোর্ট বাতিলের জন্য ১০ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গুম কমিশনের চিঠিতে বলা হয়, এ কমিশনের কার্যক্রম ফলপ্রসূ করার নিমিত্তে তদন্ত চলাকালে ওই ব্যক্তিদের দেশত্যাগে বিরত রাখার জন্য তাদের পাসপোর্ট বাতিল করে সব ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষকে অবগত করাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত আবশ্যক। তাই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ কমিশনকে অবগত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করছি। উল্লেখ্য, ৯ নভেম্বর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীদের সভায় বিস্তারিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আংশিক তালিকা সংযুক্ত করে পত্র প্রেরণ করা হলো। এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত চিঠি পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পাঠানো হয় ১৮ নভেম্বর। এরপর অধিদপ্তরের পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হলে সংশ্লিষ্টদের কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে কর্মকর্তাদের কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, স্বরাষ্ট্রের চিঠি পাওয়ার পর তালিকা অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের পাসপোর্ট বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২/৩ দিনের মধ্যেই তাদের পাসপোর্ট বাতিলের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। তাদের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে বাতিলসংক্রান্ত তালিকা পুলিশের বিশেষ শাখা এবং ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের কাছেও পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button