আরো বাড়ছে গ্যাসসংকট, শিল্প-কারখানায় উদ্বেগ
দেশে গ্যাসসংকট আরো বাড়ছে। আগে কয়েকটি এলাকায় আবাসিক গ্রাহকরা গ্যাসের সংকটে থাকলেও এখন এর ব্যাপ্তি আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে। একইভাবে সংকটে পড়ছে শিল্প-কারখানাও। কমেছে উৎপাদন, বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়।
পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাসসংকটে।
দেশে দিনে চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে গতকাল রবিবার পেট্রোবাংলা সরবরাহ করেছে দুই হাজার ৬৯১ মিলিয়ন ঘনফুট। গত মাসেও দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ছিল দুই হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি। এর আগের মাসে ছিল প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
ডলার সংকটের কারণে স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না। ঘাটতি মেটাতে দেশীয় গ্যাসের জোগান বৃদ্ধির ব্যবস্থা শিগগিরই করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় মহেশখালীতে একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর জন্য গত ১০-১২ দিন ধরে এলএনজি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। আগামী ১ নভেম্বর থেকে টার্মিনালটির মেরামতকাজ শুরু হবে এবং শেষ হতে সময় লাগবে অন্তত দুই মাস। এ সময়ে এই টার্মিনাল দিয়ে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করা বন্ধ থাকবে। ফলে আগামী বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসসংকট থাকবে।
একাধিক শিল্প উদ্যোক্তা বলেছেন, চলমান গ্যাসসংকটের কারণে তাঁরা এমনিতেই শিল্পের উৎপাদন ঠিক রাখতে পারছেন না। এ অবস্থায় যদি এলএনজি টার্মিনাল মেরামতের জন্য গ্যাসের সরবরাহ আরো কমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে শিল্প খাতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাঁরা বিকল্প উপায়ে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করে এলএনজি টার্মিনাল মেরামতে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে বর্তমানে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিলারেট এনার্জি ও সামিট গ্রুপের এই দুই টার্মিনাল দিয়ে বিদেশ থেকে জাহাজে করে আনা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা হয়। টার্মিনাল দুটির সক্ষমতা এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। স্বাভাবিক সময়ে দুই টার্মিনালের মাধ্যমে ৮০০ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস গ্রিডে সরবরাহ করা হতো। কয়েক দিন ধরে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটিতে মেরামতের কাজ শুরু হলে দৈনিক এলএনজি সরবরাহ কমে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের নিচে নেমে যাবে।
এ অবস্থায় করণীয় জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গতকাল বলেন, ‘আগামী পয়লা নভেম্বর থেকে এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল মেরামতে যাবে, যার কারণে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে গ্যাস গ্রিডে দেওয়া হবে। ১ নভেম্বর থেকে এলএনজির সরবরাহ আরো কিছুটা কমে যাবে। এতে গ্যাসের সংকট বাড়তে পারে। তবে সামনে শীত মৌসুম, বিদ্যুতের চাহিদা কমে গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কম হবে। সব কিছু মিলিয়ে সেই সময়ের গ্যাস সরবরাহ দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমরা ইচ্ছা করলেই দেশীয় কূপগুলো থেকে গ্যাস বাড়াতে পারছি না।’
ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম গতকাল বলেন, এলএনজি টার্মিনাল মেরামত করার প্রয়োজন আছে। তবে বিকল্প উপায়ে গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রেখে মেরামতের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। এই মুহূর্তে শিল্পকে বিপদের মুখে ফেলে মেরামতে যাওয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই এখন শিল্প-কারখানাগুলো ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না। দেড় থেকে দুই মাস যদি এলএনজি সরবরাহ কম থাকে, তাহলে তো এই সংকট আরো বাড়বে। এতে শিল্পের উৎপাদন কমবে, বাড়বে ব্যয়। তাই বিকল্প উপায়ে কিভাবে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো যায়, সেই দিকে নজর দিতে হবে পেট্রোবাংলাকে।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএম) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের এমডি শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘গ্যাস নেই, কারখানা চালাতে পারছি না। গ্যাসসংকটে ক্যাপটিভ (শিল্পে নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুৎ প্লান্ট) বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে পারছি না। ডলার সংকটে এলসি খুলতে না পারায় কাঁচামাল আনা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে এক ধরনের সংকট চলছে শিল্প খাতে।’
শেখ মাসাদুল আলম বলেন, ‘আমার স্টিলের তিনটি কারখানা আছে, এর মধ্যে মাত্র একটি চালু। গ্যাসের চাপ কম থাকার কারণে সেটিও ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এভাবে গ্যাসসংকট চলতে থাকলে কারখানা বন্ধ হয়ে শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেকার হয়ে যাবেন। আমার একটি কারখানাতেই এক হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করছেন।’
গ্যাসের সরবরাহ কম পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, ‘এমনিতেই তো আমরা গ্যাস পাচ্ছি না। সামনে শীত আসছে, তখন তো সাধারণত গ্যাসের চাপ কমে যায়। এর মধ্যে আবার এলএনজির সরবরাহ যদি কমে যায়, তাহলে তো আরো বিপদে পড়তে হবে। বর্তমানে সিএনজি স্টেশনগুলোকে দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা (সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত) রেশনিং করতে হয়।’
ফারহান নূর বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকায় সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ থাকে না। এতে সিএনজি মেশিনগুলো ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। গ্যাস নিতে আসা পরিবহনগুলোকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাই দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়ে সরবরাহ বৃদ্ধিতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’
পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, সূচি অনুযায়ী গত মার্চে টার্মিনালটি মেরামতের কথা ছিল। কিন্তু তখন তীব্র গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের চাহিদা থাকার কারণে তা করা যায়নি। এটি মেরামতে সময় প্রয়োজন হয় দেড় মাস। কিন্তু এক্সিলারেট এনার্জি তাদের টার্মিনাল সক্ষমতা আরো ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট বাড়াবে। ফলে প্রায় দুই মাস সময় লাগবে। তাঁরা জানান, নতুন করে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চলতি সপ্তাহে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে। এরপর এই সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম শুরু করবে এক্সিলারেট এনার্জি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, শীতকালে সাধারণত গ্যাসের চাহিদা কিছুটা কমে আসে। সে কারণে এখন এলএনজি টার্মিনালের মেরামতের উদ্যোগ নিচ্ছে। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের শিল্প খাত গ্যাসের ওপর অতি নির্ভরশীল। ভারতে বেশির ভাগ এলাকায় গ্যাস নেই, তার পরও তারা গ্যাস ছাড়া বিকল্প জ্বালানি দিয়ে কারখানা চালাচ্ছে। যেহেতু গ্যাসের সংকট চলছেই তাই বিকল্প উপায়ে কিভাবে শিল্প-কারখানা চালানো যায়, সেই উদ্যোগ না নিয়ে এখনো বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করে শিল্পে গ্যাস সংযোগ নেওয়া হচ্ছে, যার কারণে আপাতত গ্যাসের এই সংকট কমার সম্ভাবনা কম।
আবাসিকেও সংকট
শিল্পে গ্যাসসংকটের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকের চুলা জ্বলছে না। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা আব্দুল কাইয়ুম কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৫ দিন ধরে সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গ্যাস থাকে না। তাই রাতেই পরের দিনের সকাল ও দুপুরের খাবার রান্না করে রাখতে হচ্ছে। ঠিকমতো গ্যাস না পেলেও মাসে মাসে গ্যাসের বিল দিতে হচ্ছে।
এলএনজির বিশ্ববাজার অস্থির
বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। বর্তমানে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্লাটসের দর অনুসারে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম ১৮ ডলার ৪০ সেন্টে ওঠানামা করছে। গত পাঁচ সপ্তাহের ব্যবধানের ২৯ শতাংশ দাম বেড়েছে এলএনজির।
চলতি বছরে স্পট মার্কেট থেকে ২৩ কার্গো এলএনজি কেনার পরিকল্পনা ছিল পেট্রোবাংলার। এরই মধ্যে ২১ কার্গো কিনেছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী নভেম্বর ও ডিসেম্বরে দুটি কার্গো কেনা হবে।