Science & Tech

আর্কটিক অঞ্চলের বরফ পুরু করবে ড্রোন: প্রশ্নবিদ্ধ যুক্তরাজ্যের একটি স্টার্ট-আপের পরিকল্পনা

রিয়েল আইসের পরিকল্পনা অনুসারে, বৈদ্যুতিক সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে বরফের নিচে থাকা পানিকে উপরে তুলে আনা হবে এবং এসব পানি বরফের ওপর বিশালাকৃতির পুকুরের মতো জমতে থাকবে এবং বরফের স্তরকে আরও পুরু করবে।

রিয়েল আইসের পরিকল্পনা অনুসারে, বৈদ্যুতিক সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে বরফের নিচে থাকা পানিকে উপরে তুলে আনা হবে এবং এসব পানি বরফের ওপর বিশালাকৃতির পুকুরের মতো জমতে থাকবে এবং বরফের স্তরকে আরও পুরু করবে।

কানাডার আর্কটিক অঞ্চলের গভীরে, গবেষক এবং উদ্যোক্তারা তীব্র শীত, প্রচণ্ড বাতাস ও তুষারঝড় উপেক্ষা করে সমুদ্রের বরফের ভেতর গর্ত তৈরি করে নিচের সমুদ্রের পানি পাম্প করে বরফের উপর ছড়িয়ে দিচ্ছেন।

যুক্তরাজ্যের স্টার্ট-আপ কোম্পানি রিয়েল আইসের এই দলটি নুনাভুট প্রদেশের ক্যামব্রিজ বে নামের একটি ক্ষুদ্র উপকূলীয় গ্রামে অবস্থান করছেন। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে আর্কটিক অঞ্চলের বরফ বৃদ্ধি এবং পুনরুদ্ধার সম্ভব।

তাদের চূড়ান্ত পরিকল্পনা হল ক্যালিফোর্নিয়ার আয়তনের চেয়ে দ্বিগুণ আর্কটিক অঞ্চলটির ৩৮৬,০০০ বর্গমাইলেরও বেশি বরফ পুরু করা এবং এর মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন বরফ গলে যাওয়ার গতি হ্রাস করা। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হল মানবসৃষ্ট জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখা।

এটি একটি সাহসী পদক্ষেপ। তাছাড়া গ্রহের সংবেদনশীল মেরু অঞ্চলগুলো রক্ষার জন্য প্রস্তাবিত বিতর্কিত ভূ-প্রকৌশল প্রকল্পগুলোর একটি। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বরফের স্তর রক্ষার জন্য পানির নিচের একটি বিশাল ‘পর্দা’ স্থাপন করা এবং সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করতে ক্ষুদ্র কাচের কণা ছড়িয়ে দেওয়া।

কিছু আর্কটিক গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা রিয়েল আইসের পদ্ধতিকে ব্যাপক পরিসরে অপ্রমাণিত, পরিবেশগতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ মোকাবিলায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অভিযোগ করেছেন।

তবে কোম্পানিটি বলছে, তাদের প্রকল্পটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং এটি দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়া বিশ্বের জন্য একটি শেষ সুযোগ, যা একটি বিলুপ্তপ্রায় বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় সহায়তা করতে পারে।

আর্কটিকের সমুদ্রের বরফ দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে, কারণ মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে ঘন, বহু বছর ধরে জমা বরফের পরিমাণ ৯৫% হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে যেটুকু বরফ রয়ে গেছে তা নতুন এবং পাতলা। কিছু বিজ্ঞানীর পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০-এর দশকের শুরুর দিকেই আর্কটিক অঞ্চলটি একটি বরফমুক্ত গ্রীষ্মকাল পেতে যাচ্ছে।

এক গবেষক সমুদ্রের ওপর সৃষ্ট বরফের পুরুত্ব মাপছেন।

সমুদ্র বরফের এই ক্ষতি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এর উজ্জ্বল সাদা পৃষ্ট সূর্যের আলোকে মহাকাশে প্রতিফলিত করে এবং পৃথিবীকে ঠান্ডা রাখে। কিন্তু যখন এটি গলে যায়, তখন নিচের গাঢ় সমুদ্রপৃষ্ঠ সূর্যের তাপ আরও বেশি শোষণ করতে সক্ষম হয়। এটি একটি বিধ্বংসী চক্র। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বরফ গলতে থাকে এবং বরফ গলে যাওয়ার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা আরও তীব্র হয়।

রিয়েল আইসের এই সমুদ্রের বরফ রক্ষার পরিকল্পনা অনুসারে, বৈদ্যুতিক শক্তি দ্বারা চালিত সাবমার্সিবল পাম্পগুলো বরফের নিচে স্থাপন করা হবে। এর মাধ্যমে সমুদ্রের পানিকে উপরে তুলে আনা হবে। এসব পানি বরফের ওপর বিশালাকৃতির পুকুরের মতো জমতে থাকে এবং অতিরিক্ত বরফের স্তর তৈরি হয়।

রিয়েল আইসের প্রধান সহ-নির্বাহী কর্মকর্তা আন্দ্রেয়া চেকোলিনি এ বিষয়ে বলেন, এ প্রক্রিয়ার কারণে বরফের উপরের তুষারের স্তর সরে যায় এবং বরফ নীচের দিকে বাড়তে থাকে।

স্টার্ট-আপটি আর্কটিক অঞ্চলে প্রায় দুই বছর ধরে পরীক্ষা চালাচ্ছে। প্রথম পরীক্ষা ছিল গত বছর আলাস্কায়, যা মূলত যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা ও তীব্র শীতে এগুলো কার্যকর থাকবে কিনা তা যাচাই করা।

এ দলটি গত জানুয়ারি থেকে কানাডার ক্যামব্রিজ বে-তে তাদের গবেষণা শুরু করেছিল। তারা প্রায় ৪৪,০০০ বর্গফুট এলাকার বরফের স্তর জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২০ ইঞ্চি পুরু করতে সক্ষম হয়েছিল। চোকোলিনি জানান, এ বৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ছিল।

কেমব্রিজ বে-তে নভেম্বরে একটি নতুন পরীক্ষা শুরু হয়েছে এবং এখন পর্যন্ত তারা ৪৩০,০০০ বর্গফুট এলাকায় পরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করেছে। পরীক্ষার প্রথম ১০ দিনের মধ্যে তারা সেখানের বরফের স্তর ৪ ইঞ্চি পুরু করতে সক্ষম হয় বলে জানিয়েছেন চেকোলিনি।

তারা নতুন বছরের মে মাসে আবার ফিরে আসবেন এবং বরফ কতটা পুরু হলো তা পরিমাপ করবে। পূর্ববর্তী ফলাফলগুলোর ভিত্তিতে, তারা আশা করছেন যে ১৬ থেকে ৩১ ইঞ্চি বরফ বৃদ্ধি হবে বলে জানান চেকোলিনি।

‘এটা তো মাত্র শুরু’ জানালেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট রিপেয়ার-এর পরিচালক ও রিয়েল আইসের গবেষণার সঙ্গে যুক্ত শন ফিটজেরাল্ড। তিনি সিএনএনকে বলেন, “আমি আশাবাদী, তবে আমাদের আরও পরীক্ষার ও আরও তথ্যের প্রয়োজন।”

চূড়ান্ত পরিকল্পনা হলো প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর করা। এর মাধ্যমে পানির নিচে ড্রোন ব্যবহার করা হবে। এ ড্রোনগুলোর উচ্চতা হবে প্রায় ৬.৫ ফুট লম্বা এবং যা সবুজ হাইড্রোজেন দ্বারা চালিত হবে। এগুলো বরফের নিচে গরম ড্রিল ব্যবহার করে বরফে গর্ত তৈরি করবে।

চেকোলিনি ধারণা করে বলেন, পুরো স্কেলে প্রায় পাঁচ লাখ ড্রোন ব্যবহার করা হবে এবং এগুলো সাবধানে বসানো হবে যাতে পশুদের চলার পথ বা শিপিং লেনগুলো এড়ানো যায়। যদি সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে, তবে তিনি আশা করেন যে তারা আট থেকে দশ বছরের মধ্যে এটি স্কেল আপ করতে সক্ষম হবে।

তবে এটা সস্তা হবে না। রিয়েল আইসের আনুমানিক হিসেবে অনুসারে, প্রতি বছর ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে ৩৮৬,০০০ বর্গমাইল এলাকার বরফ পুরু করতে বলে জানালেন চোকোলিনি।

রিয়েল আইস মূলত স্ব-অর্থায়ন ও কিছু বিনিয়োগকারীরর অর্থেই চলছে। তারা আশা করছেন, ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা অর্থ প্রদানের এগিয়ে আসতে পারে। তারা অবশ্য ‘কুলিং ক্রেডিট’ বিক্রি করার চিন্তাও করছেন। এর মাধ্যমে যারা দূষণের জন্য দায়ী তারা তাদের দূষণ ‘অফসেট’ করার জন্য বরফ তৈরিতে অর্থ দিবে।

বরফের ওপর পানি জমে বিশালাকৃতির একটি পুকুর সৃষ্টি হয়েছে।

বিষয়টি আকর্ষণীয়। কিন্তু অনেক গবেষকরাই এখনও এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দিহান।

অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ একটি প্রকল্প

উডওয়েল ক্লাইমেট রিসার্চ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ গবেষক জেনিফার ফ্রান্সিস বলেন, গবেষকরা সঠিক বলেছেন। আমার সন্দেহ হচ্ছে, এটি কি দীর্ঘসময় ধরে সাগরে যথেষ্ট পরিমাণ বরফ তৈরি করতে পারবে কিনা। আর পারলেও এটি জলবায়ু পরিবর্তনে কোনো ভূমি রাখবে কিনা।”

ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলার এনভায়রনমেন্টাল চেঞ্জের সহকারী অধ্যাপক লিজ ব্যাগশ বলেন, “রিয়েল আইসের পরিকল্পনায় অনেক কিন্তু রয়েছে। তিনি আরও সতর্ক করেছেন যে এটি একটি দুর্বল অঞ্চলে ব্যাপক প্রাকৃতিক পরিবেশগত প্রভাব ফেলতে পারে। এমন হস্তক্ষেপগুলি নৈতিকভাবে অত্যন্ত সন্দেহজনক, সবচেয়ে খারাপ ও নীতিগতভাবেও অনৈতিক।

একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে বেশ কয়েকজন গবেষক মেরু অঞ্চলের জিও-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যার মধ্যে এ প্রকল্পটিও অন্তর্ভুক্ত। তারা ‘অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির সম্ভাবনা’ নিয়ে সতর্ক করেছেন। তারা বলেছেন, এর মধ্যে আর্কটিক অঞ্চলে অবর্ণনীয় মানুষের উপস্থিতি পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলবে।

প্রকল্পটি পরিবেশে পরিবর্তন আনতে পারে, যেমন বরফের পুরুত্বের কারণে অ্যালগির বৃদ্ধি প্রভাবিত হতে পারে। বিষয়টি অস্বীকার করেননি চোকোলিনি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে সামগ্রিক প্রভাব সীমিত থাকবে।

চোকোলিনি বলেন, “আমরা যা কিছু করি, তার একটি প্রভাব থাকে। সমস্যা হল যে, শুধু এই ভেবে, সবকিছু আগের মতো চলতে দিলে তার প্রভাব অনেক বড় হবে।”

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button