Trending

আর্থিক মন্দার প্রভাব বন্দরে

ডলার ও জ¦ালানি সঙ্কটে ব্যাহত ব্যবসা-বাণিজ্য উৎপাদন রফতানি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ডলার আয়-ব্যয়ে নেই ভারসাম্য : মাহে রমজানের মাত্র এক মাস বাকি, অথচ জাহাজ ও পণ্য ওঠানামায় নেই তোড়জোড় ব্যস্ততা ফাঁকা থাকছে জেটি-ইয়ার্ড : কমেছে কন্টেইনার ওঠানামা : বন্দর-নির্ভর আইসিডিতে আয়ের তুলনায় পরিচালনা ব্যয় বৃদ্ধি : কাস্টমসের রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি বাড়ছেই

জাহাজবহর, কন্টেইনার ও খোলা কার্গোর দীর্ঘ জট। বছরের এ সময়ে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের সাধারণ দৃশ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম চিত্র। ডলার সঙ্কটের সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দ্বিমুখী সেই সঙ্কটের সাথে যোগ হয়েছে জ¦ালানি সঙ্কট। যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে দেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎপাদনশীলতা। স্থবির হয়ে পড়েছে রফতানি ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড। আসছে না নতুন বিনিয়োগ। ডলার সঙ্কটের জেরে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে গিয়ে পদে পদে আটকে যাচ্ছেন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। মাহে রমজানের আর মাত্র এক মাস বাকি। অথচ এ সময়ে প্রতি বছর আমদানি-রফতানিমুখী জাহাজ ও পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে বন্দরসমূহে যে তোড়জোড় ও ব্যস্ততা দেখা যায় এখন তাতে ভাটার টান।

এখন আর কোন জাহাজকে বন্দরের বহির্নোঙরে অলস অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। সরাসরি ভিড়ছে জেটি-বার্থসমূহে। গত কয়েক সপ্তাহে দৈনিক গড়ে ২ থেকে ৪টি জেটি খালি থাকছে। বেসরকারি কন্টোইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) তথা অফডক, কাস্টমস সিএন্ডএফ, স্টিভিডোরিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারস, পরিবহন এজেন্সিসহ বন্দর-শিপিং কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভর ব্যবসা-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়েছে মন্দার ছায়া। স্টিল অ্যান্ড আয়রন, সিমেন্ট, নির্মাণ খাত, খাদ্যপণ্য শিল্পসহ বিভিন্ন খাত উপখাত ও লিংকেজ ধুঁকছে সঙ্কটে। ব্যাংক ঋণ দায়-দেনার বোঝা, লোকসানে দিশেহারা ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, ডলার সঙ্কটের মধ্যেও ডলারের আয় ও ব্যয়ে ভারসাম্য বা সঙ্গতি নেই।

পোর্ট-শিপিং তথ্য অনুযায়ী, সদ্যবিদায়ী ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানিমুখী কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টিইইউএস। আগের বছর ২০২২ সালে হ্যান্ডলিং করা হয় ৩১ লাখ ৩২ হাজার টিইইউএস। কন্টেইনার ওঠানামা, পরিবহন কমেছে ৯১ হাজার টিইইউএস। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হ্রাসের হার প্রায় ৩ শতাংশ। তাছাড়া আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী মার্চেন্ট জাহাজ হ্যান্ডলিংও কমেছে। গেল ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪ হাজার ১০৩টি জাহাজ আসা-যাওয়া করেছে। আগের বছর ২০২২ সালে জাহাজ আসা-যাওয়ার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৩৬১টি।

২০২৩ সালে জাহাজ হ্যান্ডলিং কমেছে ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। তবে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে খোলা সাধারণ কার্গো (ব্রেক বাল্ক) হ্যান্ডলিং এবার ১২ কোটি মেট্রিক টন অতিক্রম করেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির হার এ ক্ষেত্রে মাত্র শুন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। এদিকে গেল জানুয়ারি মাসে বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের সংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৬২ টিইইউএস। যা আগের বছর ২০২২ সালে ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৮৫৬ টিইইউএস। এক মাসে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে।

আমদানি-রফতানি পণ্য প্রবাহ হ্রাসের প্রবণতা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্র্তৃপক্ষের (চবক) সচিব মো. ওমর ফারুক দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈশি^ক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা, ডলার সঙ্কট, বিলাসজাত পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা ইত্যাদি কারণে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং কিছুটা কমলেও খোলা সাধারণ পণ্য (ব্রেক বাল্ক) কার্গো পরিবহন আগের বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যসহ অর্থনৈতিক সর্বক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারকারীদের সেবা প্রদানের জন্য বন্দর সবসময়ই প্রস্তুত। বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা, যন্ত্রপাতি ও ধারণক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। এর ফলে কোন জাহাজকে জেটিতে ভিড়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হয় না।

দেশের মোট শিপিং বাণিজ্যের প্রায় ৯২ শতাংশ প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কন্টেইনার ভর্তি আমদানি ও রফতানি পণ্য পরিবহনের ৯৮ শতাংশ পরিচালিত হয় প্রধান বন্দর দিয়ে। শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনি যন্ত্রপাতি, বাণিজ্যিক পণ্যসামগ্রী আমদানি হয় কন্টেইনারে। আবার তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে উৎপাদিত পণ্য রফতানি করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য বিভাগের ওটেক্সা’র তথ্য মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতিতে গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি ২৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি আয় কমে দাঁড়ায় ৭২৯ কোটি ডলার। ২০২২ সালে যেখানে রফতানি আয় ছিল ৯৭২ কোটি টাকা। দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশ আসে রফতানি খাতে। আমদানি ও রফতানি আয়-ব্যয় ভারসাম্যহীন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে দেশের আমদানি আয়ের পরিমান ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার এবং রফতানি আয় ২ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার। অথচ আগের বছর (২০২২-২৩ সাল) আমদানি বাবদ আয় হয় ৭ হাজার ২৮৬ কোটি ডলার এবং রফতানি ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলার।

আমদানি-রফতানি কমে যাওয়ায় বন্দর-শিপিং-কাস্টমস-পরিবহন এবং এসব খাত-উপখাতের উপর নির্ভরশীল ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় হ্রাস পাচ্ছে। বাড়ছে গচ্ছা-লোকসানের আকার। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন এসব খাতের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরা। পুরোদমে কর্মকাণ্ড চলছে না। সিংহভাগ কিংবা আংশিক কাজকর্মহীন শ্রমিক-কর্মীদের প্রায় বসিয়ে রেখেই মজুরি, বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। এতে করে দেশের দুর্বল অর্থনীতির উপর সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে নেই ভারী যানবাহনের জটলা, আগের মতো যানজট। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ে ভাটা পড়েছে। বেড়েই চলেছে ঘাটতির আকার। কাস্টমস হাউজে আগের মতো নেই সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মীদের ভিড়, দীর্ঘ লাইন। বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর আয় কমে গেছে। আমদানি রফতানি কমে যাওয়ায় ডিপোগুলোর পুরো সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অব ডকগুলোর সামনে নেই কন্টেইনারাহী ভারি যানবাহন ও কার্ভাডভ্যারে সারি। কয়েক একসময় ডিপোগুলোর সামনে রফতানি পণ্য শত শত ভারি যানবাহনের দীর্ঘ লাইন দেখা যেতো। এখন আগের অবস্থা নেই। ডিপো উপচে আশপাশের সড়কেও রাখা হতো কন্টেইনারমুভার, কার্ভাডভ্যান। এখন ডিপোতে নেই তেমন ব্যস্ততা। একই অবস্থা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশন ও পরিবহন খাতেও।

মন্দা অবস্থার প্রভাব পড়ছে দেশের সবচাইতে বড় রাজস্ব আদায়কারি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের রাজস্ব আদায়ে। সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতির আকার ছয় হাজার ৬৭১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা থেকে ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। তবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চার হাজার ১৩৬ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। কাস্টম কর্মকর্তারা জানান, আমদানি রফতানি কমে যাওয়ায় রাজস্ব আদায় চাপের মুখে পড়েছে। তাছাড়া রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে বিলাসী পণ্যের আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় রাজস্ব আয় কম হচ্ছে। তবে বিশ্ববাজারে পণ্যেও দাম বেড়ে যাওয়ায় কম আমদানির পরও গত বছরের তুলনায রাজস্ব আদায় কিছুটা বেশি হয়েছে।

আমদানি রফতানিতে মন্দার ধাক্কা লেগেছে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যে। ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমীন সিকদার বলেন, চট্টগ্রামে চালু ১৯টি বেসরকারি ডিপোর পুরো সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। কারণ আমদানি রফতানি দুটোই কমে গেছে। ডিপোগুলো এখন তাদের সক্ষমতার ৭০ ভাগ ব্যবহার করছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সার্বিক কার্যক্রম ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কমে গেছে। ফলে সমপরিমাণ আয়ও কমছে। অথচ ডিপোগুলোর পরিচালনা ব্যয় এবং কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা আগের মতই রয়েছে।

স্মার্ট গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মইনুল আহসান বলেন, বেসরকারি ডিপোগুলোর আয় ৩০ শতাংশের মত কমে গেছে। কিন্তু লোকবল আগের অবস্থায় রয়েছে। আয় কমে গেছে কিন্তু ব্যয় আগের মতই রয়ে গেছে। এতে ডিপো পরিচালনা করতে গিয়ে মালিকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। আমরা সুদিনের অপেক্ষায় আছি।

বেশি বিপাকে পড়েছেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট কর্মীরা। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসকে ঘিরে সাড়ে তিন হাজার সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ২০ হাজার মানুষ। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, আমদানি রফতানিতে ধস নামায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। তাতে আয় রোজগারও কমেছে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি রফতানি মিলিয়ে প্রতিদিন যত সংখ্যক বিল অব এন্ট্রি জমা পড়তো এখন তার মাত্র ৫০ থেকে ৫৫ ভাগ জমা পড়ছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাজ এবং আয় কমে যাওয়ায় এ খাত সংশ্লিষ্টরা আর্থিক সঙ্কট মোকাবেলা করছে।

আয় কমে গেছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদেরও। প্রাইম মুভার ওনার এসোসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবু বক্কর বলেন, আমদানি রফতানির নেতিবাচক ধারায় পরিবহন ব্যবসা অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়েছে। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় ৬০ ভাগ আয় কমে গেছে এ খাতে। আমদানি রফতানি পণ্য পরিবহন কমে যাওয়ায় বেশিরভাগ ভারী যানবাহন অলস বসে থাকছে। যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে চালক, সহকারীসহ পরিবহন শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মালিক পক্ষ। নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কম ভাড়া দিয়েও এখন পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের অনেকে এখন বেকার হতে বসেছেন। দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরকে ঘিরে পরিবহন খাতে যে বিশাল বিনিয়োগ তা এখন হুমকির মুখে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button