আ’লীগ যা দিয়েছে, তা মেনেই ভোটে জাপা
সংসদে আবারও প্রধান বিরোধী দল হওয়া নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের কাছে ৫০ আসনে ছাড় চাইলেও জাতীয় পার্টি (জাপা) পেয়েছে ২৬টি। এতে ‘ক্ষুব্ধ’ জাপা ভোট থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও, শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীনরা যা দিয়েছে, তা মেনেই গতকাল রোববার নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দেয়। এর পরপরই জাপাকে দেওয়া আসন থেকে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয় আওয়ামী লীগ।
বিএনপিবিহীন আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আসন বাটোয়ারা নিয়ে ৬ ডিসেম্বর থেকে দফায় দফায় বৈঠক করে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। গত শুক্রবার রাতে ক্ষমতাসীনরা জানিয়ে দেয়, ২৬টির বেশি আসন ছাড়া হবে না। লাঙ্গলের দখলে থাকা সাতটি আসন এ তালিকায় নেই। দলের তিন কো-চেয়ারম্যানও ছাড় পাননি। এর পরই শনিবার মধ্যরাতে জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা এক হয়ে ইঙ্গিত দেন, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির হিসাব না মিললে বিকল্প ভাববেন। জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের আরও কিছু আসন চেয়ে তালিকা পাঠান। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে সাড়া দেয়নি।
প্রত্যাশিত সংখ্যক আসন না পেয়ে গতকাল সকাল ১১টার দিকে দলের বনানী কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে জাপার নেতাকর্মী। নির্বাচন বর্জনের দাবিতে প্রেসিডিয়াম সদস্য আলমগীর শিকদার লোটনের নেতৃত্বে মিছিল হয়। এর পর বিপুল সংখ্যক পুলিশ অবস্থান নেয় কার্যালয়ের সামনে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে নিজ কার্যালয়ে তখন বৈঠক করছিলেন জি এম কাদের।
সূত্র জানিয়েছে, জাপা চেয়ারম্যান তাঁর স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য ঢাকা-১৮, কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার জন্য ঢাকা-৪, সালমা ইসলামের জন্য ঢাকা-১ অথবা ঢাকা-১৭, প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকার জন্য নারায়ণগঞ্জ-৩ চেয়ে শনিবার রাত থেকেই দেনদরবার করছিলেন। ২৬ আসনের সীমাবদ্ধতা মেনে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন পিরোজপুর-৩, সাতক্ষীরা-২, হবিগঞ্জ-১ এর মতো আসন। আওয়ামী লীগের কাছে যে ৫০ আসন চেয়েছিল জাপা, তাতে এ তিনটি ছিল না। আবার জাপা যেসব আসন চেয়েছিল, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নেতারা প্রার্থী হওয়ায়, আওয়ামী লীগ সেগুলো ছাড়েনি। যেসব আসনে কম গুরুত্বপূর্ণ নেতারা প্রার্থী হয়েছেন, সেগুলোই ছেড়েছে আওয়ামী লীগ।
রাজধানীর রাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় আওয়ামী লীগ শুক্রবারই জানিয়ে দেয়, ঢাকায় আসন ছাড়া হবে না। জাপা সূত্র জানিয়েছে, গতকাল সকালের পর জি এম কাদের অন্য নেতাদের জন্য চেষ্টা বাদ দিয়ে স্ত্রী শেরিফা কাদের যেন ঢাকা-১৮ আসনে ছাড় পান, সে প্রচেষ্টা চালান। আওয়ামী লীগের দিক থেকে তখন জানানো হয়, শেরিফা কাদেরের জন্য আসন ছাড়তে হলে তালিকার ২৬ থেকে একজনকে বাদ দিতে হবে। এর পর সিলেট-৩ আসন ছেড়ে দেয় জাপা। এখানে ছাড় পেয়েছিলেন লাঙ্গলের প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিক।
বছর দুয়েক ধরে সরকার ও নির্বাচন ব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করছেন জি এম কাদের। তিনি নির্বাচন থেকে সরে যেতে পারেন বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু শেরিফা কাদেরের আসন নিশ্চিতের পর আওয়ামী লীগ যা দিয়েছে, তা মেনে নেন জি এম কাদের। গতকাল বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে বনানী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনে থাকার ঘোষণা দেন জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তবে এর আড়াই ঘণ্টা আগে একই স্থানে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচনে থাকবে কিনা তা বিকেল ৪টার দিকে জানানো হবে।
জাপা সূত্র জানিয়েছে, এই আড়াই ঘণ্টায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে দেনদরবার চলে। ছাড় পাওয়া যাচ্ছে না নিশ্চিত হয়ে বিকেল ৩টার দিকে জি এম কাদেরের বনানী কার্যালয় থেকে বিমর্ষ মুখে বেরিয়ে যান ঢাকা-৪ আসনে দু’বারের এমপি আবু হোসেন বাবলা। আসন পাচ্ছেন না– নিশ্চিত হয়ে গত শনিবার মধ্যরাতে দলীয় বৈঠক ছেড়ে চলে যান ঢাকা-৬ আসনের দু’বারের এমপি জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ। তিনি গতকাল প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত শোনা যাচ্ছিল, দলের আরেক কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার পটুয়াখালী-১ আসনে ছাড় পাবেন না। তবে রাত ১টার দিকে আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসে, তাঁকে আসন ছাড়া হবে। তবে ২৬ সংখ্যা ঠিক রাখতে রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নাকে বরিশাল-৬ আসন ছাড়া হবে না। তিনি এ আসনে দু’বারের এমপি।
জাপা সূত্র আরও জানিয়েছে, দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেন লক্ষ্মীপুর-১ আসনে মাহমুদুর রহমান মাহমুদ ও নেত্রকোনা-৩ এ জসীম উদ্দিন ভূঁইয়াকে যেন ছাড় দেয় আওয়ামী লীগ। এতে কাজ না হলেও হিসাবের বাইরে চট্টগ্রাম-৫ আসনে ছাড় পেয়েছে। এ আসনে জাপার প্রার্থী একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর আত্মীয়।
জাপাকে ঠাকুরগাঁও-৩, নীলফামারী-৩ ও ৪, রংপুর-১ ও ৩, কুড়িগ্রাম-১ ও ২, গাইবান্ধা-১ ও ২, বগুড়া-২ ও ৩, সাতক্ষীরা-২, পটুয়াখালী-১, বরিশাল-৩, পিরোজপুর-৩, ময়মনসিংহ-৫ ও ৮, কিশোরগঞ্জ-৩, মানিকগঞ্জ-১, নারায়ণগঞ্জ-৫, ঢাকা-১৮, হবিগঞ্জ-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ফেনী-৩, চট্টগ্রাম-৫ ও ৮ আসন ছেড়েছে আওয়ামী লীগ। সরিয়ে নিয়েছে নৌকার প্রার্থী। তবে কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়ে গেছেন। ফলে মাঠ ফাঁকা থাকলেও জাপার জয় নিশ্চিত নয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনেও জাপাকে ২৬ আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। এবার সেখান থেকে লালমনিরহাট-৩, বগুড়া-৬ ও ৭, বরিশাল-৬, ময়মনসিংহ-৪, ঢাকা-৪ ও ৬, নারায়ণগঞ্জ-৩, সিলেট-২, সুনামগঞ্জ-৪ এবং লক্ষ্মীপুর-২ আসন ছাড়েনি। এর মধ্যে লালমনিরহাট-৩, বরিশাল-৬, ময়মনসিংহ-৪, ঢাকা-৪ ও ৬, নারায়ণগঞ্জ-৩ এবং সুনামগঞ্জ-৪ আসনসহ সাতটিতে এখনও জাপার এমপি রয়েছেন।
জাপাকে নতুন করে দেওয়া হয়েছে– ঠাকুরগাঁও-৩, গাইবান্ধা-২, কুড়িগ্রাম-১, পটুয়াখালী-১, সাতক্ষীরা-২, বরিশাল-৩, ময়মনসিংহ-৫, মানিকগঞ্জ-১, ঢাকা-১৮, হবিগঞ্জ-১ ও চট্টগ্রাম-৮। গতবার এসব আসন ছাড়েনি আওয়ামী লীগ। তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিবিহীন নির্বাচনে ঠাকুরগাঁও-৩, কুড়িগ্রাম-১, পটুয়াখালী-১, বরিশাল-৩, ময়মনসিংহ-৫ ও হবিগঞ্জ-১ ছেড়েছিল। ওই নির্বাচনে জাপা ছাড় পেয়েছিল ৪২ আসনে। ২০০৮ সালে জোট করে পেয়েছিল ২৯ আসন।
বিকেলের সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুল হক চুন্নু আগের মতোই দাবি করেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা নয়; সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে– সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের এ আশ্বাসে নির্বাচনে থাকছেন। ২৮৩ আসনে জাপার প্রার্থী থাকবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটে টক্কর দেবেন। ২৬ আসনে সমঝোতার বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘সোমবার এ বিষয়ে বলা যাবে।’ টক্কর দিতে চাওয়া দলের সঙ্গে আসন বাটোয়ারা প্রশ্নে উষ্মা প্রকাশ করে জাপা মহাসচিব বলেন, ‘এটা আমার কৌশল। আপনাদের (সাংবাদিক) জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।’
আওয়ামী লীগের কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ চেয়ে জাপা পেয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২। আওয়ামী লীগের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের চিঠি অনুযায়ী, ওই আসন ছাড়া হয়েছে জাপার আবদুল হামিদ ভাসানীকে। তবে গতকাল বিকেলে তাঁকে প্রতীক বরাদ্দের চিঠি না দিয়ে জি এম কাদের লাঙ্গল তুলে দিয়েছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে।