Bangladesh

আলু এখন বিলাসী পণ্য

ভাতের বিকল্প হিসেবে দেশের মানুষকে একসময় আলু খাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতো সরকার। ‘ভাতের ওপর চাপ কমান, বেশি করে আলু খান’-এরকম একটা গান বেশ জনপ্রিয় ছিল। কারণ আলু দামে ছিল সস্তা। যা সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে ছিল। কিন্তু এ বছর গরিবের আলু যেন বিলাসী পণ্য।

রবিবার (১০ নভেম্বর) রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৭০-৭৫ টাকায়। মূলত, মৌসুমের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে কৃষক উৎপাদনের ৬৫ শতাংশ আলু বিক্রি করে দেন। এর এক মাসের মাথায় তারা আরও ২৫ শতাংশ আলু বিক্রি করেন। বলতে গেলে কৃষকের ঘরে থাকা আলু জুনের মধ্যেই বিক্রি শেষ হয়ে যায়। যেটুকু থাকে তা বীজ ও পরিবারের খাবারের জন্য।

প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, গত বছর মৌসুমের শুরুতে কৃষকরা প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেছিলেন ১৪-১৬ টাকায়। কিন্তু চার মাসের মাথায় সরবরাহ সংকটের অজুহাতে আলুর বাজার চড়া হয়ে ওঠে। কেজিতে ৩৫ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি আলু  পাইকারিতে বিক্রি হয়েছিল ৫৫ টাকায়। আর এখন খুচরায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়। 

খুচরা ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, আলুর দাম বাড়ার জন্য পাইকাররা দায়ী। আর পাইকাররা দুষছেন হিমাগার মালিকদের। তারা বলছেন, কৃষকের থেকে কম দামে আলু কিনে, হিমাগার ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি আলুতে অন্তত ২০ টাকা লাভ করছেন। হিমাগার থেকে আলু নিয়ে তাদের নিজস্ব ফড়িয়া সিন্ডিকেট সদস্যরা ১০ টাকা লাভে দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করেন। এতে হিমাগার থেকে বের হতেই প্রতি কেজি আলুতে ৩০ টাকা বাড়ে যায়। এতে চাপ পড়ে খুচরা পর্যায়ে। আর খুচরাতে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়।

কাওরান বাজারের আলুর পাইকার ব্যবসায়ী মো. সজিব দেশ রূপান্তরকে বলেন, ৭ বছরের মতো ব্যবসা করছি। এর মধ্যে গত ৩ বছর শুধু আলুর ব্যবসা করি। কিন্তু এবারের মতো অন্য বছর আলুর দাম এতো বাড়েনি। 

তিনি বলেন, আলুর অস্বাভাবিক দাম বাড়ে শুধু অসাধু হিমাগার মালিকদের জন্য। এসব মালিক ও তাদের এজেন্টরা এবার প্রতি কেজি আলুর দাম বাড়িয়েছে ৩০ টাকা। 

রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশর (টিসিবি) তথ্যানুসারে, গত ৪ বছরে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে গড়ে ৭০ শতাংশ। এর মধ্যে ২০২২ সালে প্রতি কেজি আলুর দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ, ২০২৩ সালে বেড়েছিল ৬৬ ও চলতি বছরে বেড়েছে রেকর্ড ৮৭ শতাংশ।

বর্তমানে খুচরা বাজারে বিক্রি হওয়া ৭০-৭৫ টাকা আলু ২০২১ সালে বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১৬ টাকায়। পরের বছর ৮ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ২৪ টাকায়। এর পরের বছরে ১৬ টাকা বেড়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ৪০ টাকায়। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে কৃষকের হাতে আলু না থাকলেও পর্যাপ্ত পরিমাণ আলু রয়েছে হিমাগার মালিক ও মজুতদারদের ভাণ্ডারে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আড়তদার ও মজুতদাররা বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। উৎপাদন ও মজুত অনুযায়ী আলুর সরবরাহে সংকট নেই। 

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে জয়পুরহাট ও মুন্সীগঞ্জ এলাকার হিমাগার গুলোতে প্রায় ৪ লাখ টন আলু সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে জয়পুরহাটের ১৯টি হিমাগারে এবার আলু সংরক্ষণ হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৫০০ টন। এবং মুন্সীগঞ্জের ৫৪ হিমাগারে আলুর মজুদ রয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার টন।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, আমরা বরাবর বলে আসছি আমাদের কৃষি পণ্যের সংকট নেই। তবে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের জন্য বছরজুড়ে বাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়িতে থাকে। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত আলু দিয়ে আমাদের চাহিদা মিটে যায়। পাশাপাশি এই আলু বিশ্বের নানা দেশেও রপ্তানি করা সম্ভব। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ীরা বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। 

তিনি আরও বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার খুব বেশি দরকার। বিশেষ করে প্রতিযোগীতামূলক বাজার ব্যবস্থা চালু করতে প্রতিযোগীতা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে বাজারের প্রতিযোগীতা নিশ্চিত করা থেকে কাগুজে প্রতিযোগীতাই বেশি। এছাড়াও সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রণকারী অন্য সংস্থাগুলোকেও তাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল করা দরকার। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button