Hot

আলোচনায় ‘জাতীয় ঐক্য’ কীভাবে হবে স্পষ্ট নয়

কয়েক দিনের নৈরাজ্যে উদ্বিগ্ন রাজনৈতিক দলগুলো। মোকাবিলায় সরকার, রাজনৈতিক দল এবং অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্ব জাতীয় ঐক্যের কথা বললেও কীভাবে হবে, তা স্পষ্ট নয়। নির্বাচন, কূটনৈতিক সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে তাদের মতবিরোধ প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসছে। তবে নানামুখী চাপ মোকাবিলা ও অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সব পক্ষ ‘ঐকমত্য’ নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে।

দলগুলোর সূত্রের ভাষ্য, অন্তর্বর্তী সরকার কঠোর না হওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। যখন-তখন রাস্তা বন্ধ করে আন্দোলন এবং বিশৃঙ্খলায় জননিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ অনিরাপদ বোধ করছেন। ধর্মীয় ইস্যু এবং হুটহাট দাবিতে কূটনৈতিক সম্পর্কেও এর প্রভাব পড়ছে। শৃঙ্খলা না ফিরলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তাই নৈরাজ্য দমনে শক্ত হতে হবে সরকারকে। নইলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের শক্তির বিভেদে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সমর্থনে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সুযোগ নিতে পারে। তা ঠেকাতে অভ্যুত্থানের সব শক্তির জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন।

বিএনপি গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে জাতীয় ঐক্যের কথা বলে। গতকাল বৃহস্পতিবার জামায়াত নেতারা যমুনায় সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকে জানান, বিএনপির জাতীয় ঐক্যের আহ্বানের সঙ্গে তারাও একমত। যদিও এ দুই দলের মধ্যে এবং বিএনপির সঙ্গে ছাত্র নেতৃত্বের মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে। 

রাজনৈতিক দলগুলো চলমান অস্থিরতার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করছে। তাদের দৃঢ় সন্দেহ, ক্ষমতাচ্যুতদের ষড়যন্ত্র রয়েছে। তা মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। যদিও স্পষ্ট করছে না– জাতীয় ঐক্য বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, কীভাবে হবে এ ঐক্য। যদিও বিএনপি সংস্কারের ৩১ দফায় ঘোষণা করে রেখেছে, ক্ষমতায় গেলে আন্দোলনের সব শক্তিকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। 

বিএনপি সূত্রের ভাষ্য, ধর্মীয় ইস্যুতে কিছু হঠকারিতা চলছে। ইসকন বিতর্কও অহেতুক। অভ্যুত্থানের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ‘ইনফ্লুয়েন্সাররা’ তাদের অনুসারীদের দিয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। সংবাদপত্রের কার্যালয়ে হামলা এবং সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপের কারণে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এতে বার্তা যাচ্ছে– সরকার দেশ চালাতে পারছে না। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে হাজারো মানুষের রক্তস্নাত অভ্যুত্থানে প্রতিষ্ঠিত সরকার জনসমর্থন হারাবে। সরকার ব্যর্থ হলে অন্য কোনো পক্ষ সুযোগ নিতে পারে। 

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জামায়াতের বৈঠক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, ইসকন প্রসঙ্গ না উঠলেও চট্টগ্রামে আইনজীবীকে হত্যার বিষয়ে আলোচনা হয়। যারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটাবে, তাদের শক্ত হাতে দমনে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ জানান জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান। 

প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য তিন উপদেষ্টাও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক– এ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ‘এনগেজমেন্ট’ বাড়াতে সরকারপ্রধানকে পরামর্শ দেন জামায়াত আমির। ড. ইউনূস তাতে ঐকমত্য পোষণ করেন। ভারত থেকে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা চলছে– তা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। জবাবে তিনি এখন থেকে সব অপপ্রচারের পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা হবে বলে জানান।

জামায়াত সূত্রের ভাষ্য, সরকার কোনো কাজই ঠিকঠাক এগিয়ে নিতে পারছে না। কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েও মাঝপথে পিছিয়ে এসেছে, যা ভালো লক্ষণ। অভ্যুত্থানের সফলতা ধরে রাখতে সরকারের সুস্থিরতা প্রয়োজন। কিন্তু ছাত্রসহ অভ্যুত্থানের নানা শরিক যেভাবে নানা দাবিতে হুটহাট সরব হচ্ছে, চাপ তৈরি করছে, তাতে সুস্থিরতা আসছে না। 

সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একটি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা সমকালকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষত বিএনপি উদ্বেগ থেকেই ঐক্যের কথা বলছে। দলটির শঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে অভ্যুত্থানের বৃহত্তম শরিক হিসেবে দায় নিতে হবে। নৈরাজ্য চললে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তৃতীয় পক্ষ এ পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কিছুটা সংগঠিত হতে শুরু করায়, তারা এতে সমর্থন দেবে। আবার ছাত্র নেতৃত্ব যেভাবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে মুখোমুখি করছে, তাও ক্ষতির কারণ হতে পারে। বড় রাজনৈতিক দলগুলো তাই স্থিতিশীলতা চায়, যাতে নির্বাচন দ্রুত হয়। 

সরকারের উপদেষ্টারাও জাতীয় ঐক্যের কথা বলছেন। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, রাজনৈতিক দল, জনগণ বা সরকার এখানে আলাদা কিছু নয়। বাংলাদেশের অখণ্ডতা রক্ষা এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার এ কাজ সবার। এই ঐক্য ধরে রাখলে আশা করি, আর কখনোই ফ্যাসিজম ফিরে আসবে না। বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও অখণ্ডতা ও ঐক্যের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে কীভাবে কাজ করা যায়, তা বলেছেন। যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা-উন্মত্ততা কীভাবে রুখে দেওয়া যায়, সে বিষয়ে সবার সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দুটি দলই বিভিন্ন ইতিবাচক প্রস্তাব দিয়েছে। তারা আগের মতোই সরকারকে সহযোগিতা করার কথা বলেছে।

গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সতর্ক করে বলেন, ফ্যাসিবাদ যে কোনো সময় আবার ফিরে আসতে পারে। সেই রাস্তা যেন তৈরি করে না দিই। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন কতগুলো কাজ করছি, লড়াই করছি; নিজেরা ভাইয়ে ভাইয়ে রক্ত ঝরাচ্ছি। যে কাজগুলোর মধ্য দিয়ে কিন্তু ফ্যাসিবাদ ফিরে আসার শঙ্কা অনেক বেড়ে গেছে। 

তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি না করে ঐক্যের মধ্যে থেকেই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেখানে আমরা কোনোমতেই যেন আর কোনো বিভাজন সৃষ্টি না করি। শান্ত থেকে ধীরে ধীরে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে যেতে হবে। এ ছাড়া আর কোনো পথ নেই।

নেতারা ঐক্যের কথা বললেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণা চলছে। এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করছে। ঐক্যের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সমকালকে বলেন, দেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত হলেও তারা ষড়যন্ত্র করছে। ফিরে আসতে চাইছে। চট্টগ্রামে আইনজীবীকে হত্যা করে একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর যে ষড়যন্ত্র জাতি দেখেছে, তাতে ফ্যাসিবাদরা ফিরে আসার ইঙ্গিত বহন করে। এ সময়ে ঐক্যের ডাক ইতিবাচক।

বিভেদের বিষয়ে রাজনৈতিক সূত্র জানায়, সরকারকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় বিএনপি। সরকার যাতে একটি রোডম্যাপ দিয়ে দ্রুত নির্বাচনমুখী হয়, সে তাগিদও অব্যাহত রাখছে। কিন্তু জামায়াত, ছাত্র নেতৃত্বের অবস্থান ভিন্ন। তারা সংস্কারে গুরুত্ব দিচ্ছে।

আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে জামায়াত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠছে কিনা– এ চিন্তাও রয়েছে বিএনপির মধ্যে। ছাত্র নেতৃত্বের প্ল্যাটফর্ম জাতীয় নাগরিক কমিটি যেভাবে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিরোধিতা করেছে, তা ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি। তারা নির্বাচন কমিশন গঠনকে স্বাগত জানিয়েছে।

প্রশাসনিক রদবদলেও বিএনপির আপত্তি দেখা গেছে। জামায়াতও একই আপত্তি তুলেছে। বৈঠকের পর দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন। একই সঙ্গে ন্যূনতম সংস্কারের পর যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন প্রয়োজন। জাতি-ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সবাই মিলে জাতীয় ঐক্য আরও কীভাবে দৃঢ় করা যায়; প্রশাসনে আরও কীভাবে গতি আনা যায়; এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি আলোচনা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি, যেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। এটাকে লাঘব করার জন্য মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে দ্রব্যমূল্য আনার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। শফিকুর রহমান বলেন, শান্তিশৃঙ্খলা কারা ধ্বংস করতে চায়? তাদের চিহ্নিত করতে এবং ঐক্যবদ্ধভাবে এটাকে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের সংস্কারের ৪১ দফা দাবি আছে। এই সরকারের জন্য আমরা ৪১ দফা দিইনি। আমরা মাত্র ১০ দফা দিয়েছি। আমরা চাই, এই সংস্কারগুলো দ্রুত করা দরকার।

জামায়াতের প্রতিনিধি দলে ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা সমকালকে বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই জাতীয় ঐক্যের কথা বলে আসছি। দেশের সার্বভৌমত্ব যদি রক্ষা করতে হয়, তাহলে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়েই এগোতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এই ঐক্য ধরে রাখতে আগ্রহী। এ জন্য সব ছাত্র সংগঠনের ঐকমত্য তৈরিতে কর্মসূচি করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যেভাবে সংঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করছে, সে ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন। তবে আওয়ামী লীগের তো বিচার হতে হবে।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d