Bangladesh

আসন বন্টনে শেষ বেলায় নাটকীয়তা

বিএনপিহীন ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ৫০ আসনে ছাড় পাওয়ার আশায় ছিল সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা)। ক্ষমতাসীনরা ২৫ থেকে ২৬ আসন ছাড়ার আশ্বাস দিলেও গতকাল শনিবার রাতে গুঞ্জন ছড়ায়, তা আরও কমবে। ছাড় দেওয়া আসনে নৌকার প্রার্থী তুলে নেওয়া হলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী সরাবে না আওয়ামী লীগ। এতে পরাজয়ের শঙ্কায় ক্ষুব্ধ প্রত্যাশিত আসন না পাওয়া জাপা। যেসব নেতা আসন পাননি, তারা দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উপস্থিতিতে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। জাপা সূত্র সমকালকে এসব তথ্য জানিয়েছে। 

সূত্রটি আরও জানায়, ২৫ থেকে ২৬ আসনে ছাড় পেলেই নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা বলেছেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। তবে বাকিরা এত কম আসন নিয়ে ভোটে যাওয়ার পক্ষপাতী নন। বিশেষ করে যারা আসন ছাড় পাননি, তারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পক্ষে মত দিচ্ছেন। 

আসন সমঝোতা করতে ৬ ডিসেম্বর থেকে চার দফা বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগ ও জাপার জ্যেষ্ঠ নেতারা। ৬ ডিসেম্বরের বৈঠকে ৬০ আসন, পরে ১২ ডিসেম্বরের বৈঠকে ৫০ আসনের তালিকা দেয় জাপা। ফের সংসদের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার প্রত্যাশা ছিল– অন্তত ৪০ আসনে জয়ের নিশ্চয়তা দেবে আওয়ামী লীগ। 

সর্বশেষ গত শুক্রবার রাতের বৈঠকের পর জানা যায়, ২৫ থেকে ২৬ আসন ছাড়বে আওয়ামী লীগ। গতকাল সন্ধ্যায় জানা যায়, সংখ্যাটি কমে ২২ থেকে ২৩ হতে পারে। তবে রাতে জাপা চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি এক প্রেসিডিয়াম সদস্য সমকালকে বলেন, সংখ্যাটি আরও কমে ১৭ থেকে ১৮ হতে পারে। এসব আসনে নৌকার প্রার্থী থাকবে না। তবে আসনগুলোতে শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী থাকবে কিনা, তা জানাতে পারেননি ওই নেতা। 

শুক্রবার রাতে বৈঠকের পর জানা যায়, আওয়ামী লীগ জাপাকে ১২ আসনে জেতানোর নিশ্চয়তা দিয়েছে।  ছাড় দেওয়া বাকি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী না থাকলেও নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা থাকবেন। তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হবে লাঙ্গলকে। 

এ শর্তে ক্ষুব্ধ জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ নেতারাও। গত তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট ও সমঝোতা করেছে জাপা। ২০১৪ সালের বিএনপিহীন নির্বাচনে জাপাকে ৪২ আসন ছেড়েছিল আওয়ামী লীগ। গতবার ছেড়েছিল ২৬ আসন। এর ২১টিতে এবং বরিশাল-৩ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে হারিয়ে জয় পায় লাঙ্গল। পরবর্তী সময়ে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে উপনির্বাচনে জয় পায়।  
এই ২৩ আসনের ২১টি চেয়েছিল জাপা। বর্তমান এমপি জাপার এমন একজন কো-চেয়ারম্যানের আসনে আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীর স্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। জাপার ওই কো-চেয়ারম্যান চান, জয় নিশ্চিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীকেও সরিয়ে দেওয়া হোক। তবে এতে সায় নেই আওয়ামী লীগের।

আজ রোববার মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে আসন বণ্টন বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হতে পারে। গতকাল শনিবার কোথায় বৈঠক হয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে একটি সূত্রের ভাষ্য, গতকাল আওয়ামী লীগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হয়েছে জাপা নেতাদের। কী আলোচনা হয়েছে, তা জানাতে পারেনি সূত্রটি।

সন্ধ্যার পর আনিসুল ইসলাম মাহমুদের গুলশানের বাসায় জাপা চেয়ারম্যান,  কো-চেয়ারম্যানরা, মহাসচিব এবং কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য বৈঠকে বসেন। কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলামের জন্য ঢাকা-১ অথবা ঢাকা-১৭ আসন চাওয়া হয়েছিল। এর কোনোটিই ছাড়তে রাজি হয়নি আওয়ামী লীগ। এতে ক্ষুব্ধ সালমা ইসলাম। আসন না পাওয়ায় এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বৈঠক ছেড়ে চলে যান। তিনি নির্বাচন করবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন। 

এক কো-চেয়ারম্যান রাতে বলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ সবার শত্রু হয়েছে জাপা। আওয়ামী লীগ যে আশ্বাস দিয়েছিল, তা রাখেনি।

ক্ষমতাসীনরা কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত দলগুলোকে বিরোধী দল বানাতে চেয়েছিল। তবে দলগুলো বিএনপি নেতাদের ভাগিয়ে নির্বাচনে আনতে না পারায় এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। আওয়ামী লীগ আগামী সংসদে দলের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র এমপিদের বিরোধী দল বানিয়ে জাপাকে তিন নম্বরে নামিয়ে দিতে পারে বলে শঙ্কায় রয়েছেন এই কো-চেয়ারম্যান।

গুলশানের বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, নেতাদের ক্ষোভের মুখে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এক নেতাকে ফোন করেন মুজিবুল হক চুন্নু। তিনি বলেন, জাপা যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে থাকতে চায়। তবে প্রত্যাশিত আসন না দেওয়ায় সব পর্যায়ের নেতারা হতাশ। এ থেকে অন্যরকম পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জাপা দায়ী নয়।

তবে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে জাপা মহাসচিব জানান, তাঁর দল নির্বাচনে থাকবে। তিনি রসিকতা করে আসন সমঝোতার জন্য আওয়ামী লীগকে দেওয়া তালিকাকে প্রেমের চিঠির উপমা দেন। আবারও দাবি করেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা আসন বণ্টনের জন্য নয়, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, কিছু আসনে জিতিয়ে আনতে সমঝোতার কথাও আছে।

আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত কয়টি আসন ছাড়বে জাপাকে– তা প্রকাশ করেননি চুন্নু। একে রাজনৈতিক কৌশল আখ্যা দিয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন ভবিষ্যতে প্রকাশ করা হবে। জাপা মহাসচিব বলেন, ‘প্রেমের চিঠির কথা কেউ প্রথমে মা-বাবাকে বলে না। তবে যখন বিয়ের প্রসঙ্গ আসে, তখন বলতেই হয়।’ আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রেম কোন পর্যায়ে রয়েছে– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রেমে বিরহ আসে। তার পর গভীর হয়, এর পর পরিণতি পায় বিয়ের মাধ্যমে।’

মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘যদি নির্বাচনটা হয়, ভোটাররা কেন্দ্রে আসার আস্থা পায়, তাহলে নীরবে-নিভৃতে ভোট বিপ্লব হয়ে যেতে পারে। আর বেশি তো লাগে না। ১৫১ আসন পেলেই হয়।’ জাপার ১৫১ আসন পাওয়ার সামর্থ্য আছে কিনা– প্রশ্নে রসিকতার সুরে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘বললাম না, বিয়ের আগে চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করব। হয়তো সবচেয়ে সুন্দরী না, তবে কাছাকাছি বিয়ে করতে পারছি। আশা তো করি (১৫১ আসন পাওয়ার)। আশা পূরণ হয় অনেক সময়, অনেক সময় হয় না। আশার দোলাচলই জীবন। 

আপিলে বৈধতা পাওয়ার পর ২৮৬ আসনে জাপার প্রার্থী রয়েছে। মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, লাঙ্গলের কেউ প্রত্যাহার করবে না। জাপাকে ছেড়ে দেওয়া আসনে নৌকার প্রার্থী প্রত্যাহার করা হবে কিনা– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কোনো মার্কা প্রত্যাহারে কৌশল আছে, এটা আমরা এখনও বলতে চাই না, সেটা আজ আমরা বলব না, কাল বলতে পারি।’

নির্বাচন থেকে সরে যেতে হুমকি দেওয়া হয়েছে অভিযোগ করে গত বৃহস্পতিবার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন জি এম কাদের। এ প্রসঙ্গে চুন্নু বলেন, ‘নির্বাচন থেকে চলে যাওয়ার জন্য আসি নাই। তবে হুমকি আমার ফোনেও একটা না, বহু আছে। বাট আই ডোন্ট বদার, আই ডোন্ট কেয়ার। নির্বাচনে যাব, এটা আমার রাজনীতি। আমি নির্বাচন ফেস করব।’

জাপার নেতারা জয়ের নিশ্চয়তা চান কিনা– প্রসঙ্গে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘পার্লামেন্টারি রাজনীতিতে অনেক সময় দেখা যায় স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের আসনে অনেকে নির্বাচন করেন না। অনেক বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান যারা, তাদের অনেক সময় ছাড় দেওয়া হয়। চরম বিরোধী দল থাকলেও ছাড়ের প্রশ্ন আসে।’

আগের দিনগুলোর মতো জাপা মহাসচিব আবারও দাবি করেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আলোচনায় আসন বণ্টন মুখ্য নয়। নির্বাচন কীভাবে ভালো করা যায়, সেই কথা চলছে। তা ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে জানিয়ে বলেন, ‘কোন কোন পার্লামেন্টারিয়ান এলে ভালো হয়, তারা আসতে পারেন কিনা, সে বিষয়ে আলোচনা যে হয়নি, তা নয়, হয়েছে।’

Show More

8 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button