Bangladesh

আসামি গ্রেপ্তারে গড়িমসি, পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ

গাজীপুরে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলামছবি: সংগৃহীত

গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিকনেতা শহিদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডে আর কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন শহিদুলের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। তাঁরা বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে যাঁর মদদ রয়েছে, তাঁর নাম মামলায় উল্লেখ করতে দেয়নি পুলিশ। আর এখন আসামিদের ধরতে গড়িমসি করছে।  

ঈদের আগে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শ্রমিকদের বকেয়া বেতন–ভাতা না দেওয়ায় গত ২৫ জুন রাত সাড়ে নয়টার দিকে টঙ্গীর সাতাইশ বাগানবাড়ী এলাকার ‘প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডে’ যান শহিদুল। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে কারখানা থেকে বেরিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর তাঁর ওপর হামলা হয়। গুরুতর আহত শহিদুলকে গাজীপুরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই রাতেই তাঁর মৃত্যু হয়। শহিদুল বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি ছিলেন।

এ ঘটনায় পরদিন ২৬ জুন সকালে শহিদুলের সংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে ছয়জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় আরও সাতজনকে আসামি করা হয়।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় মো. মাজাহারুল নামের একজনকে। মামলা দায়েরের পর ওই দিন রাতেই তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মাজাহারুল বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানার সাধারণ সম্পাদক। এই মামলার অপর আসামিদের মধ্যে রিপন ওই শ্রমিক সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক। পুলিশ বলছে, সোহেল, রাসেল ও আকাশ নামে সংগঠনটির আরও তিন নেতাকেও আসামি করা হয়েছে। এঁদের বাইরে ‘ম্যানেজার হানিফ’ নামে একজনকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে বলা হয়, মে মাসের বকেয়া বেতন, ঈদের বোনাস ও জুন মাসের (২৫ তারিখ পর্যন্ত) বেতন নিয়ে কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ চলছিল। গত ২৫ জুন সব পাওনা পরিশোধ করার কথা দেয় মালিকপক্ষ। কিন্তু দিন চলে গেলেও শ্রমিকেরা টাকা পাননি। খবর পেয়ে কারখানাটিতে যান শহিদুল ও তাঁর নেতা-কর্মীরা। পাওনা বুঝে পেতে শ্রমিকদের করণীয় সম্পর্কে বোঝান তাঁরা। পরে কারখানা থেকে বের হতেই তাঁদের ওপর হামলা চালান স্থানীয় মো. মাজাহারুল, সোহেল, রাসেল, রিপন, আকাশ, ‘ম্যানেজার হানিফ’সহ অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ থেকে সাতজন।

‘কামরুলের নাম বাদ দিতে বলেন ওসি’

নিহত শহিদুলের সংগঠনের নেতারা বলছেন, হানিফের নেতৃত্বে শহিদুলের ওপর হামলা করে সন্ত্রাসীরা। হানিফ স্থানীয় প্রভাবশালী জমি ব্যবসায়ী মো. কামরুল ইসলামের ঘনিষ্ঠজন। এই কামরুলের কাছ থেকে জমি কিনেই ওই কারখানা গড়েন প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেডের মালিক মো. সাইফুদ্দিন। স্থানীয় সূত্রের তথ্যমতে, কামরুলের সঙ্গে সাইফুদ্দিনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এই সূত্র ধরেই কামরুলের ‘ম্যানেজার’ হানিফের নির্দেশে শহিদুলের ওপর হামলা চালানো হয়।

প্রত্যক্ষদর্শী ও কারখানার শ্রমিক সূত্রে জানা যায়, ঘটনার দিন রাত নয়টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের শান্ত করে কারখানা থেকে বের হন শহিদুল ও তাঁর সঙ্গের নেতারা।

কারখানার মূল ফটক থেকে একটু সামনে যেতেই হানিফের সঙ্গে দেখা হয় শহিদুলের। তাঁদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে কথা হয়। এরপর কিছুক্ষণের মধ্যেই হানিফ লোকজন ডেকে তাঁর ওপর হামলা চালান।

এ বিষয়ে মামলার বাদী কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বারবার মামলায় কামরুলের নাম উল্লেখ করতে চেয়েছি। কিন্তু ওসি আমাদের কথা শোনেননি। তিনি কামরুলের নাম বাদ দিতে বলেন। পরে আমরা শুধু হানিফের বিরুদ্ধেই অভিযোগ দিই। এটা পুলিশের স্পষ্টত পক্ষপাতমূলক আচরণ।’ তিনি বলেন, ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা সবাই স্থানীয় মুখ। পুলিশ চাইলেই তাঁদের গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু এরপরও আর কোনো আসামি ধরা পড়ছে না। এটা হতাশাজনক।

এই অভিযোগ অস্বীকার করে টঙ্গী পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শাহ আলম বলেন, ‘তাঁরা শুধু বলছিলেন “কামরুলের ম্যানেজার”। তাঁরা হানিফের নাম জানতেন না। পরে আমরাই ম্যানেজার হানিফ নাম বলে দিয়েছি। তা ছাড়া কামরুল ইসলাম ঘটনাস্থলে ছিলেন না বা এই কারখানার তিনি কেউ নন। আমরা সবদিক বিবেচনা করেই তদন্ত এগোচ্ছি।’

ওসি মো. শাহ আলম বলেন, এ ঘটনায় কারখানার মালিক মো. সাইফুদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাইফুদ্দিন দাবি করেছেন, তিনি এই হামলার বিষয়ে কিছুই জানেন না।

জমি ব্যবসায়ী কামরুল দাবি করেছেন, হানিফ নামে তাঁর কোনো ম্যানেজার নেই। ওই কারখানার মালিকের সঙ্গেও তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই।

এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য কারখানার মালিক মো. সাইফুদ্দিনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

পুলিশ বলছে সাংগঠনিক দ্বন্দ্ব, নেতাদের অস্বীকার

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টঙ্গী পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক উৎপল কুমার বলেন, শহিদুলের বিরোধী পক্ষ বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন কাজ করে টঙ্গীতে। শহিদুল হঠাৎ সেখানে শ্রমিকদের পক্ষে কাজ করতে গেলে দুই সংগঠনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। এর জেরে শহিদুলের ওপর হামলা চালানো হয়।
তবে পুলিশের এ কথার সঙ্গে একমত নন শ্রমিক সংগঠন দুটির নেতারা। আসামি মাজাহারুলের সংগঠন বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি তুহিন চৌধুরী বলেন, দুই সংগঠনের মধ্য কোনো বিরোধ নেই।

শহিদুলের সংগঠনের সভাপতি কল্পনা আক্তারও একই কথা বলছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকারীরা সবাই মালিকপক্ষের লোক—এটা পানির মতো পরিষ্কার। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেই শহিদুলকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এখানে কোনো ক্ষমতার বিরোধ নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button