আ.লীগের নানা অপতৎপরতা পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে ‘অপারেশন চক্রবাল’

দেশকে অস্থিতিশীল করতে নতুন করে অপতৎপরতা শুরু করেছে নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ। তাদের একের পর এক গোপন মিশন ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কৌশল পালটাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ‘অপারেশন চক্রবাল’ নামে তিন মাস মেয়াদি একটি নতুন ছক বাস্তবায়নের অপচেষ্টা করছে। এর অংশ হিসাবে ঝটিকা মিছিল থেকে শুরু করে চারদিকে নানা কৌশলের ফাঁদ তৈরি করছে। অবশ্য সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ইতোমধ্যে তাদের গোপন অপতৎপরতা জেনে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। খবর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের।
জানা যায়, প্রশাসন, সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার আড়ালে যারা আ.লীগের ছায়াশক্তি এবং দেশবিরোধী ক্রীড়ানক হিসাবে কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা ইউনিট ও এর বাইরে প্রাইভেট ডিটেক্টিভদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করছে। সেই সঙ্গে নাশকতা ও অস্থিতিশীলতায় জড়িতদের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জানা যায়, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব দেশত্যাগ করলেও অসংখ্য নেতাকর্মী দেশে আত্মগোপনে আছে। তাদের দিয়েই কষা হচ্ছে নাশকতা ও ষড়যন্ত্রের ছক। একাধিক নাশকতার পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সবশেষ নতুন পরিকল্পনা ‘অপারেশন চক্রবাল’ বাস্তবায়নের অংশ হিসাবে শুরু করেছে ঝটিকা মিছিল, গাড়ি ভাঙচুর, বাজারে আগুন, বাসে ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা অপতৎপরতা। এসবের নেতৃত্বে রয়েছে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ছোট ছোট গ্রুপ। অপর একটি গ্রুপ কাজ করছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। তারা দেশ-বিদেশে তাদের সমর্থক বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা দোসরদেরও কাজে লাগাচ্ছেন পলাতক পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা সুকৌশলে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে বিভাজন তৈরির ফাঁদ পেতেছেন। ‘অপারেশন চক্রবাল’র টার্গেট তিন মাসের মধ্যে যে কোনো দিন ২০ থেকে ৩০ লাখ লোক ঢাকায় জড়ো করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার গোপন রিপোর্ট ও মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দা অনুসন্ধান বলছে, অদৃশ্য শক্তির মতো আওয়ামী লীগ এখনো রাজপথে ভয়ংকর তৎপরতা চালাচ্ছে।
সূত্র জানায়, আ.লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-সিআরআইয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। দিল্লিতে অফিস খুলে বসে তিনি পুরোদমে চালাচ্ছেন সংগঠনটির গোপন কর্মকাণ্ড। ‘অপারেশন চক্রবাল’ এর আইডিয়াটি পুতুলের কাছ থেকেই এসেছে। পুতুল সিআরআইর দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক দেশবিরোধী সুকৌশলী ষড়যন্ত্রের ছক কষা হচ্ছে। আইডিয়া বাস্তবায়নে যারা দেশে কাজ করছেন, তাদের হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। বিদেশে পাচার করা অর্থ নাশকতার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে বলেও সূত্রটি জানায়।
একটি গোয়েন্দা সূত্রের তথ্যে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও তার ঘনিষ্ট শীর্ষ নেতারা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেও ঢাকাসহ সারা দেশে ছড়িয়ে আছে তাদের অপকর্মের নেটওয়ার্ক। ঢাকার মিরপুর, মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, সায়েন্সল্যাব থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট সেল গড়ে উঠেছে। এই সেলগুলো কখনো ঝটিকা মিছিল, কখনো তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ, আবার কখনো রাতের আঁধারে ককটেল বিস্ফোণের মাধ্যমে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে।
গোয়েন্দা তথ্য আরও বলছে, আ.লীগের সুবিধাভোগীদের কেউ কেউ সামাজিক ও ব্যবসায়িক সংগঠন কিংবা ধর্মীয় প্ল্যাটফর্মের আড়ালে এখনো সক্রিয়। তারা গোপনে আওয়ামী লীগের পলাতক শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। সংগঠন, সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সুশীল পরিচয়ে নানা বিভ্রান্তিও ছড়ানো হচ্ছে। নতুন করে ভিন্ন কায়দায় আওয়ামী বয়ান তৈরিতে যুক্ত থাকাসহ মধ্যে ‘মঞ্চ-৭১’ নাম দিয়ে ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট অন্যদেরও রাখা হয়েছে নজরদারিতে। এছাড়া বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে যারা উঁচু গলায় কথা বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই হবে না, কিংবা আ.লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে প্রশ্ন উঠবে-তাদের গতিবিধিও নজরদারি করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট ইউনিট। কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের সংশ্লিষ্টতা পেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা রয়েছে। প্রপাগান্ডায় জড়িতদের একে একে আইনের আওতায় আনতে কঠোর হচ্ছে সরকার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আ.লীগের সরাসরি রাজনীতিতে ফেরার পথ আপাতত বন্ধ। তাই গোপন নাশকতা ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, আওয়ামী লীগের এ ষড়যন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী হতে দেওয়া হবে না। নিরাপত্তা সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গোপন সেলগুলোকে দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার জন্য। যারা বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইন প্রয়োগেরও প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরে বিভাজন সৃষ্টিকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে।
এদিকে, গত কিছুদিন যাবৎ রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক, জেলা শহরের মোড়, এমনকি উপজেলার ছোট বাজারে হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়ো হয়ে হাতে পতাকা নিয়ে ঝটিকা মিছিল করে ৫-৭ মিনিটের মধ্যেই সটকে পড়ার সবগুলো ঘটনা খাটো করে দেখছে না কেউ। যদিও পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে কাউকে খুঁজে পায় না। কিন্তু রোববার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে কঠোর নির্দেশনা দেওযার পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন।
জানা যায়, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। মাঠপর্যায়ে ঝটিকা মিছিল থামাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের প্রত্যাহারেরও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী, পুলিশের পেট্রোলিং, গোয়েন্দা নজরদারি ও চেকপোস্ট জোরদারের কথা জানানো হয়। তবে গত ৮ দিনে ঢাকাসহ সারা দেশে শতাধিক ঝটিকা মিছিল করেছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। ভিডিও ফুটেজ দেখে সাবেক এমপিসহ ৭৫ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। সারা দেশ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে আরও অনেককে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, নিষিদ্ধ ছাত্র লীগ ও আওয়ামী লীগের মিছিলকারীরা বেশির ভাগ সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে সরাসরি বার্তা আদান-প্রদান করছে। ফলে গোয়েন্দারা তথ্য সংগহে তারাও নতুন কৌশল অবলম্বন করছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) এএইচএম শাহাদাত হোসাইন বলেন, পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি দেশ অস্থিতিশীল করতে কৌশল পরিবর্তন করে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। অতীতে তাদের সব ধরনের কৌশল আমরা ব্যর্থ করে দিয়েছি। যেসব ক্ষেত্রে গোয়েন্দা তথ্য পাচ্ছি সেগুলোর ক্ষেত্রে আগাম ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেসব ক্ষেত্রে অগ্রিম তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না, সেগুলোর ক্ষেত্রে পররবর্তীতে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ডিএমপির উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যেসব স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকে না, তারা সেই স্থানগুলো বেছে নেয়। তবে মিছিল পরবর্তী ভিডিও ফুটেজ দেখে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপদেষ্টা পরিষদ থেকে নির্দেশ দেওয়ার পর দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে কাউকে ছাড় না দেওয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থানে থাকতে চায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রোববার প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক এক বৈঠকে এ বিষয়ে বেশকিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ঝটিকা মিছিলসহ বেআইনি সমাবেশ রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং-ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে নির্দেশ দেন।