বৈঠকের আগে আওয়ামী লীগ–বিএনপির ‘শক্তি’ দেখানোর কৌশল
ইইউ ও মার্কিন প্রতিনিধিদল
নয়াপল্টনে আগামী বুধবার সমাবেশ করে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দেবে বিএনপি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল যখন ঢাকায়, ঠিক তখনই সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছে বিএনপি। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আগামী বুধবার সমাবেশ করে এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি। এই সমাবেশের প্রস্তুতির কাজও শুরু করেছে দলটি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ পুরোপুরি নির্বাচনমুখী কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। বিএনপির এক দফা ঘোষণার দিনে ঢাকায় পাল্টা সমাবেশের কর্মসূচি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি। ঢাকায় সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের আগে দুই দলই নিজ নিজ অবস্থানের সমর্থনে রাজপথে শক্তি দেখানোর কৌশল নিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করতে পারে।
বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ও নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অনুসন্ধানী অগ্রগামী দল ঢাকায় এসেছে গত শনিবার। ইইউ প্রতিনিধিদলের এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি মাঠে রেখে তাঁরা ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে যাবেন। সে জন্য ওই বৈঠকের আগেই সমাবেশে বড় জমায়েত করে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ইইউ প্রতিনিধিদলকে বিএনপি প্রথমত একটি বার্তা দিতে চাইছে যে তারা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসেছে এবং তাদের অবস্থান ও দাবির প্রতি মানুষের সমর্থন রয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণায় খুব স্বাভাবিক কারণেই ক্ষমতাসীনেরা ক্ষুব্ধ হবে। কিন্তু ইইউ দল যেহেতু ঢাকায় রয়েছে, তাই সমাবেশের জন্য সরকারের অনুমতি পাওয়া সহজ হবে। কোনো বাধা ছাড়াই নির্বিঘ্নে সমাবেশ করার সুযোগ নিতে চান তাঁরা।
বিএনপি একদিকে যেমন ‘সময়ের সুযোগ’ নিতে চাইছে, অন্যদিকে সরকারের ওপর মাঠের চাপ আর বাড়াতে চাইছে। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের ছয় মাস বাকি। ডিসেম্বরের শেষে বা জানুয়ারির প্রথম দিক নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে তিন মাস আগে অক্টোবরে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। এর আগে যে তিন মাস সময় আছে, তার মধ্যে আন্দোলন যদি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে সরকারের পক্ষে একতরফাভাবে এগোনোটা সহজ হবে বলে বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন।
মানুষকে সম্পৃক্ত করে, এমন কর্মসূচি দিয়ে এক দফার আন্দোলন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে চাই। সেভাবেই আমাদের নেতা–কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতাও সরকারের জন্য সুখকর হচ্ছে না। বিদেশি চাপ আরও বাড়তে পারে বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদেরও অনেকে ধারণা করেন।
যদিও ভূরাজনীতির মেরুকরণে রাশিয়া, চীন ও ভারতের সমর্থন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে থাকবে বলেই ভাবছেন বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। তবে তাঁরা এটিও মনে করেন, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ দেশের নানামুখী স্বার্থের কারণে সরকারের পক্ষে উন্নয়ন সহযোগী পশ্চিমা দেশগুলোর চাপ এড়ানো কঠিন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে তাঁরা যুগপৎ আন্দোলন করলেও এই আন্দোলন সরকারকে এখনো বড় কোনো চাপে ফেলতে পারেনি। ফলে সরকার দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দিক থেকে তেমন চাপ অনুভব করছে না এবং বিরোধী দলের আন্দোলনকে গুরুত্ব দিতে চাইছে না। কিন্তু ভিসা নীতি ঘোষণাসহ আন্তর্জাতিক নানা তৎপরতার কারণে সরকার চাপে পড়েছে নিঃসন্দেহে। এর সঙ্গে বিএনপির জোরদার আন্দোলন পরিস্থিতি সরকারের জন্য অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা তৈরি করেছে।
বিএনপির ওই নেতা অবশ্য মনে করেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তাঁদের আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন মহল থেকে সহিংসতার অভিযোগ উঠেছিল। পরের নির্বাচনে ২০১৮ সালে আন্দোলন সেভাবে গড়ে তুলতে না পারায় সরকারের সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচনে যেতে হয়েছিল বিএনপিকে। তবে এবার পরিকল্পনার ভিত্তিতে আন্দোলন একটা পর্যায়ে এসেছে এবং তাঁরা চূড়ান্ত পথে এগোনোর একটা সম্ভাবনা দেখেছেন। সে কারণে শুধু বিদেশি চাপের ওপর নির্ভর না করে বিএনপি রাজপথে শক্তি দেখাতে চাইছে।
বিএনপি প্রায় সময় সেখানে সমাবেশ করে। এটা নতুন কোনো খবর নয়। সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছেন। দেখে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক
অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ও কূটনীতিকদের তৎপরতা বিএনপিকেও একধরনের চাপে ফেলেছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপে স্বীকার করেছেন। কারণ, তাদের কর্মসূচিতে কোনো সহিংসতা হলে সেটা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সে জন্য বিএনপি হরতাল–অবরোধে না গিয়ে সতর্কতার সঙ্গে পদযাত্রা ও সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে আসছে। এখন সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে বিএনপি পদযাত্রা ও সমাবেশের পাশাপাশি ঢাকামুখী কর্মসূচি রাখবে। এর মধ্যে লংমার্চ, নির্বাচন কমিশন, সচিবালয় বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও থাকতে পারে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষকে সম্পৃক্ত করে, এমন কর্মসূচি দিয়ে এক দফার আন্দোলন আমরা শান্তিপূর্ণভাবে এগিয়ে নিতে চাই। সেভাবেই আমাদের নেতা–কর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া আছে।’
এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দিতে বিএনপি ঢাকার নয়পল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ১২ জুলাই সমাবেশ করার জন্য পুলিশের অনুমতি চেয়ে চিঠি দিয়েছে। শরিক দল ও জোটগুলোও একই দিনে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের ঘোষণা দেবে।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শুরু থেকেই পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপির এক দফার আন্দোলনের ঘোষণার সমাবেশের পাল্টা সমাবেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
নয়াপল্টনে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন,বিএনপি প্রায় সময় সেখানে সমাবেশ করে। এটা নতুন কোনো খবর নয়। সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে পুলিশ ও গোয়েন্দারা কাজ করছেন। দেখে-বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শুরু থেকেই পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপির এক দফার আন্দোলনের ঘোষণার সমাবেশের পাল্টা সমাবেশ দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
ঢাকায় ইইউ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকের আগে আওয়ামী লীগও রাজপথে নিজেদের অবস্থান রাখছে। দলটির নেতারা বলেছেন, ১২ জুলাই ঢাকায় তাঁদের সমাবেশেও বড় জমায়েত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন করার অবস্থানে অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটি নির্বাচনমুখী নানা কর্মসূচিও নিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, তাঁদের জনসমর্থন আছে এবং সেটি তাঁরাও ঢাকায় সফররত বিদেশিদের দেখাতে চান।
ইইউ দলের পাশাপাশি এ সপ্তাহেই ঢাকায় আসছে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এই দলে রয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া। বাংলাদেশ সফরের সময় মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানব পাচার, শ্রম সমস্যা ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি। বিশেষ করে নির্বাচন ও মানবাধিকার ইস্যুতে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং দুই দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন উজরা জেয়ার।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজপথে তাদের শক্তি দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে যেমন চাপে ফেলতে চাইছে, তেমনি দুই দলই নিজেদের অবস্থানের পক্ষে বিদেশিদের ওপরও একধরনের চাপ তৈরি করতে চাইছে। ইইউ প্রতিনিধিদল বা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যখন দুই দল বৈঠক করতে যাবে, তখন রাজপথে শক্তি দেখানোর বিষয়টি আলোচনায় দর–কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ধরনের চিন্তা থেকেই দুই দলই বিদেশিদের এসব সফরকে গুরুত্ব দিয়ে এখন রাজপথে শক্তিমত্তা প্রদর্শনের কৌশল নিয়েছে।