ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য ইয়েমেনি মার্সেনারিদের নিয়োগ দিয়েছে রাশিয়া
ইয়েমেনিদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তার মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে রাশিয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে, যার জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মস্কোর ক্রমবর্ধমান বৈরিতা।
ইউক্রেনে লড়াই করতে শত শত ইউমেনি যোদ্ধাকে নিয়োগ দিয়েছে রাশিয়া। গোপন আদম পাচারের মাধ্যমে তাঁদেরকে আনা হয়েছে। এই ঘটনা, মস্কোর সাথে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার আভাস দিচ্ছে।
এরমধ্যেই রাশিয়ায় আসা ইয়েমেনি যোদ্ধাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে এবিষয়ে নিশ্চিত করেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ গণমাধ্যম- ফিন্যান্সিয়াল টাইমস (এফটি)। তাঁরা জানিয়েছেন, হুথি সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তাঁরা রাশিয়ায় এসেছেন। এরপর তাঁদের চাপ দিয়ে রুশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি করা হয়, এবং ইউক্রেন যুদ্ধের সম্মুখভাগে লড়াই করতে পাঠানো হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে বিপুল সেনা হতাহত হয়েছে উভয় পক্ষেই। ভাড়াটে যোদ্ধাদের চাহিদা তাই বাড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থায়নে পশ্চিমা ভাড়াটে যোদ্ধারা যেমন ইউক্রেনের হয়ে লড়ছে, তেমনি রাশিয়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সৈনিক সংগ্রহ করছে। তবে ইয়েমেনি এই পুরুষদের বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় যুদ্ধে অংশ নিতে আসেননি। রাশিয়ায় আসার পরে তাঁরা বিষয়টি জানতে পারেন। কেউ কেউ অবশ্য জেনেশুনেই আসেন।
যুদ্ধে হতাহত বাড়ায়– রাশিয়া নিজ দেশ থেকে আরেকটি ব্যাপক সেনাভর্তি কার্যক্রম এড়াতে চাইছে। কারণ এতে জনমনে অসন্তোষ বাড়ে। এই এড়াতে চাওয়ার থেকেই ক্রেমলিন বিদেশিদের যুদ্ধে নিয়োগ দিচ্ছে। ইতঃপূর্বে ভারতীয় ও নেপালিদের ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়ার খবর সামনে আসে। যাদেরকে রাশিয়ায় আকর্ষনীয় চাকরির প্রস্তাব দিয়ে আনা হয়েছিল, এবং পরে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করা হয়। এছাড়া, বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার প্রায় ১২ হাজার সেনা রাশিয়ায় অবস্থান করছে। রাশিয়ার কুর্স্ক অঞ্চলের কিছু এলাকা দখল করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী, তাঁদের বিরুদ্ধে লড়তেই উ. কোরীয়দের আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে ইয়েমেনিদের নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও তার মিত্র সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে রাশিয়ার আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে, যার জন্য দায়ী পশ্চিমা বিশ্বের সাথে মস্কোর ক্রমবর্ধমান বৈরিতা।
এর আগে তেহরান-সমর্থিত হুথি সশস্ত্র গোষ্ঠী লোহিত সাগরে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্রদের মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও সামরিক জাহাজে মিসাইল হামলা চালিয়েছে, যাতে ব্যাহত হয়েছে বিশ্ববাণিজ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল। মূলত, গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা সমর্থনে ইসরায়েলের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বন্ধের প্রচেষ্টায় এসব হামলা চালানো হয়।
এই প্রেক্ষাপটে মার্কিন কূটনীতিকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ক্রেমলিন ও হুথিদের মধ্যে আঁতাত হওয়া ছিল অকল্পনীয়, যা এখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, রাশিয়া লক্ষ্য অর্জনে কতদূর এগোতে পারে, এমনকী তা মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য অঞ্চলে এই সংঘাতের প্রভাবকে ছড়িয়ে দিয়ে হলেও।
লোহিত সাগরে হুথিদের আক্রমণে আগুন লাগা একটি জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার জাহাজ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েমেন-বিষয়ক বিশেষ দূত টিম লেন্ডারকিং ইয়েমেনিদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, হুথিদের সাথে নানান চুক্তিতে করতে সক্রিয় চেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া, যার মধ্যে অস্ত্র হস্তান্তরের চুক্তিও আছে। তবে এবিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাতে অস্বীকার করেন তিনি।
লেন্ডারকিং বলেন, “আমরা জানতে পেরেছি, এসব বিষয়ে আলোচনাকে গভীর করতে সানায় (ইয়েমেনের রাজধানী) কিছু রুশ কর্মকর্তা অবস্থান করছেন। সেখানে যে ধরনের অস্ত্র প্রদানের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই উদ্বেগজনক– এসব অস্ত্রের মাধ্যমে লোহিত সাগরে চলাচলকারী জাহাজকে আরও ভালোভাবে টার্গেট করতে পারবে হুথিরা, এমনকী লোহিত সাগরের বাইরেও আঘাত হানতে পারবে।”
ইয়েমেনিদের সই করা এধরনের নিয়োগ চুক্তি-ও দেখেছে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস। নিয়োগদাতা কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে বিশিষ্ট হুথি রাজনীতিক আবদুলওয়ালি আবদো হাসান আল-জাবরি। প্রতিবেশী ওমানে কোম্পানিটি নিবন্ধিত। নিবন্ধনের কাগজে এটিকে একটি ট্যুর অপারেটর বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া, কোম্পানির অন্য ব্যবসা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে খুচরাপর্যায়ে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ।
অন্তত চলতি বছরের জুলাই থেকে ইয়েমেনিদের সেনা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে বলে মনে করছে এফটি। পত্রিকাটি গত ৩ জুলাইয়ের একটি নিয়োগপত্রও দেখেছে, এতে স্বাক্ষর ছিল রাশিয়ার নিঝনি নভোগ্রোদ শহরে অবস্থিত চুক্তিভিত্তিক সেনানিয়োগ কেন্দ্রের প্রধান নির্বাচকের।
নাবিল নামের একজন নিয়োগপ্রাপ্তের সাথে ‘টেক্সট ম্যাসেজ’ এর মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারে এফটি। তিনি গণমাধ্যমটিকে বলেন, মস্কো আসার পর গত সেপ্টেম্বরে তাঁকে রুশ বাহিনীতে (ভাড়াটে সেনা হিসেবে) ভর্তি করা হয়। তাঁর ধারণা, অন্তত আরও ২০০ ইয়েমেনিকেও এসময় রুশ বাহিনীতে যুক্ত করা হয়।
এদের মধ্যে কারো কারো যুদ্ধে অংশ নেওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকলেও – অনেকেরই তা ছিল না। তাঁদেরকে ভুল বুঝিয়ে রাশিয়ায় আনা হয়। যেহেতু চুক্তিপত্রে কী লেখা ছিল– সেটি পড়ার মতো শিক্ষাও তাঁদের নেই। নাবিলের ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছে।
প্রকৃত নাম গোপন রাখার শর্তে কথা বলেন তিনি এফটির সাথে, নাবিল তাঁর ছদ্মনাম। এই যুবক দাবি করেন, ‘নিরাপত্তা’ ও ‘প্রকৌশল’ এমন বিভিন্ন খাতে আকর্ষনীয় বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে রাশিয়ায় আনা হয়। তিনি আশা করেছিলেন, রাশিয়ায় করা আয় দিয়ে পড়াশোনা শেষ করবেন।
কিন্তু, রাশিয়ায় আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই ইয়েমেন থেকে আসা আরও চারজনের সাথে তাঁকে ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পাঠানো হয়। তাঁদের মোতায়েন করা হয় সেখানকার একটি বনে, যেখানে শত্রুপক্ষের টানা আক্রমণের মুখে পড়েন তাঁরা। নাবিল বলেন, “আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ হচ্ছিল, চারদিকে শুধু ভূমি মাইন আর ড্রোন, আর দিনরাত কেবল পরিখা খুঁড়ে চলা।’ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড মানসিক চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা, একজন সহযোদ্ধা আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন বলে জানান নাবিল, পরে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
নাবিলের পাঠানো ভিডিও পাঠান এফটিকে। যেখানে সবাইকে সামরিক পোশাক ও স্কার্ফে মুখ ঢাকা অবস্থায় দেখা গেছে। নাবিলের দাবি, এটি ওই বনে তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের ভিডিও। চারিদিকে প্রতিপক্ষের পুঁতে রাখা মাইন, এরমধ্যেই বাঙ্কার নির্মাণের জন্য মুখ ঢাকা এসব সেনাদের কাঠের তক্তা বহন করতে দেখা যায়।
নাবিল বলেন, “আমাদের পাঁচ মিনিট জিরোনোরও সুযোগ দেওয়া হয় না। আমরা সত্যিই খুব ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত।”
ভাড়াটে যোদ্ধা নিয়োগে রাশিয়ান নিয়োগপত্রের একটি নমুনা। ছবি: ফিন্যান্সিয়াল টাইমস
এর দিনকয়েক পর এফটিকে আরেকটি ম্যাসেজ পাঠান নাবিল। সেখানে জানান, তাঁদেরকে কোনো শীতের পোশাক দেওয়া হয়নি। নাবিলের এক চাচা বাস করেন যুক্তরাজ্যে। তিনি জানান, সম্প্রতি আহত হয়েছে তাঁর ভাতিজা, তবে এবিষয়ে আর বিস্তারিত বলতে পারছেন না।
প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানিয়ে ‘আব্দুল্লাহ’ ছদ্মনামের আরেক ইয়েমেনি জানান, তাঁকে প্রতিমাসে ২ হাজার ডলার বেতন, ১০ হাজার ডলার বোনাস এবং রাশিয়ান নাগরিকত্ব লাভের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি ড্রোন প্রস্তুতকারক কারখানায় কাজের কথা বলে আনা হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় পৌঁছান তিনি ও তাঁর সঙ্গে আসা অন্যরা। কিন্তু, বিমানবন্দর থেকেই তাঁদের একটি গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় মস্কো থেকে পাঁচ ঘণ্টা দূরের একটি গন্তব্যে। সেখানে তাঁদের সাথে আরবিতে কথা বলেন এক ব্যক্তি। নতুন একটি চুক্তিপত্রে সই করতে বলেন ওই ব্যক্তি, এতে তাঁরা প্রথমে রাজি নাহলে ওই ব্যক্তি তাঁদের মাথার ওপর দিয়ে পিস্তলের গুলি ছোঁড়েন।
আব্দুল্লাহ বলেন, “ভয় পেয়ে আমরা সই করতে বাধ্য হই। তখন আমাদের নামকাওয়াস্তে কিছু সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে ইউক্রেনগামী একটি বাসে তুলে দেওয়া হয়। বাসটি আমাদের ইউক্রেন সীমান্তের কাছে রোস্তভের সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যায়।”
তিনি আরও বলেন, আমার সঙ্গে যারা (ইয়েমেন থেকে) এসেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এরমধ্যে নিহত হয়েছেন। আমরা প্রতারক আদমপাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়ে এখানে এসেছি। আমাদের যা বলা হয়েছিল– সবই মিথ্যা।
ইয়েমেন নিয়ে গবেষণাকারী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সানা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের প্রধান মাগেদ আলমাহাজি বলেন, লোহিত সাগর অঞ্চল বা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে রাশিয়া আগ্রহ দেখাচ্ছে। একারণেই রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধে সহায়তা করতে– এসব ভাড়াটে যোদ্ধার বন্দোবস্ত করে দেয় হুথিরা। এটা মস্কোর সাথে তাঁদের সম্পর্ক তৈরির অংশ।
এবিষয়ে জানতে আনসারাল্লাহ’র (হুথি আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক নাম) একজন মুখপাত্রের সাথেও যোগাযোগ করে ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, তবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে চলতি মাসের শুরুতে আনসারাল্লাহ’র পলিট ব্যুরোর একজন সদস্য রাশিয়ার একটি নিউজ সাইট মেডুজাকে জানান, রুশ নেতৃবৃন্দের সাথে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। “অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক-সহ সর্বক্ষেত্রে সম্পর্ক গড়ে তোলাই” – যার লক্ষ্য।
তবে খুব কম সংখ্যক ভাড়াটে ইয়েমেনি যোদ্ধারই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ রয়েছে। এদের অনেকে ইউক্রেনে যেতে চায় না দাবি করে ব্রিটিশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউজের একজন উপসাগরীয় অঞ্চল বিশেষজ্ঞ ফারিয়া আল মুসলিমি বলেছেন, “রাশিয়ার যে জিনিসটি দরকার তা হলো– সেনা, হুথিরা যে রাশিয়ার জন্য নিয়োগ কার্যক্রম চালাচ্ছে তা এখন স্পষ্ট।” তাঁর মতে, এটি রাশিয়ার প্রতি হুথিদের আন্তরিকতার বহিঃপ্রকাশ। তাছাড়া, ইয়েমেনে বেকার খুঁজে পাওয়া খুবই সহজ। এটি অত্যন্ত দরিদ্র দেশ।